বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সর্বাধিক পঠিত


শরীয়তপুরে চিকিৎসকের অবহেলায় হাসপাতালে শিশুর মৃত্যু


১৪ মার্চ ২০২৪, ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ 

শরীয়তপুরে চিকিৎসকের অবহেলায় হাসপাতালে শিশুর মৃত্যু
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

ঠান্ডা ও পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তিন মাসের শিশু মুসাফিরকে। হঠাৎ অবস্থা গুরুত্বর হওয়ায় মুসাফিরের স্বজন ও দায়িত্বরত নার্স একাধিকবার খবর দিলেও আসেননি দায়িত্বরত চিকিৎসক। তবে চিকিৎসক শরীফ উর রহমান নার্সকে পরামর্শ দিয়েছিলেন অক্সিজেন খুলে তার কাছে নিয়ে যেতে। শিশুটির অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় নার্স অক্সিজেন খুলতে অপারগতা প্রকাশ করলেও ডাক্তার রোগীর কাছে যেতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে থেকেও চিকিৎসকের অবহেলায় প্রাণ হারাতে হয়েছে শিশু মুসাফিরকে।

গতকাল বুধবার (১৩ মার্চ) রাত পৌনে ৮ টায় শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটেছে।

অভিযুক্ত চিকিৎসক হাসপাতালটির মেডিকেল অফিসার শরীফ উর রহমান। এর আগেও তার বিরুদ্ধে একই অভিযোগে একাধিক রোগীর মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।

নিহত মুসাফির (৩ মাস) শরীয়তপুর পৌরসভার চরপালং গ্রামের রাজিব শেখ ও রুবিনা বেগম দম্পত্তির ছোট ছেলে।

শিশুটির স্বজন ও হাসপাতালের দায়িত্বরত নার্সরা জানায়, মুসাফিরকে ঠান্ডা ও পেটে ব্যাথা ব্যথাজনিত সমস্যা নিয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ করেই মুসাফির অসুস্থ্য হয়ে পড়লে প্রথমে তার স্বজনরা নার্স ডাকতে গেলে নার্সের রুম থেকে আয়া পাঠানো হয়। আয়া এসে মুসাফিরকে অক্সিজেন লাগিয়ে দিয়ে যায়। আয়া কেন অক্সিজেন লাগাবে বিষয়টি শিশুটির মা জানতে চাইলে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন আয়া। এরপর নার্স এসে শিশুটিকে দেখলে নার্স রোগীর স্বজনদের চিকিৎসক ডাকার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর স্বজনরা দায়িত্বরত চিকিৎসক শরীফ উর রহমানকে একাধিকবার ডাকলেও তিনি আসেননি। এদিকে রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে গেলে নার্স প্রথমে ওয়ার্ডবয় ও আয়াকে পাঠান দায়িত্বরত চিকিৎসককে ডাকতে। এরপরেও চিকিৎসক না আসলে নার্স নিজেই যান চিকিৎসক ডেকে আনতে। কিন্তু দায়িত্বরত চিকিৎসক নার্সকে পরামর্শ দেন অক্সিজেন খুলে তার কাছে নিয়ে আসতে। রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে গেছে বলে নার্স অক্সিজেন খুলতে অপারগতা প্রকাশ করলেও চিকিৎসক শরীফ উর রহমান শিশু মুসাফিরকে শেষ পর্যন্ত দেখতে যাননি। এরপর শিশু মুসাফির হাসপাতালেই মারা যায়।

ডামুড্যা থেকে এক শিশুকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালটিতে এসেছেন জুলেখা বেগম। তিনি বলেন, যারা হাসপাতাল ঝাড়ু দেয়, ময়লা পরিষ্কার করে তাদেরকে দিয়ে ইনজেকশন, স্যালাইন ও অক্সিজেন দেওয়া হয়। যদি আয়ারাই এসব করবে তাহলে হাসপাতালে নার্স ও চিকিৎসক আছে কি করতে? এমন করলে তো আমরা গরীব মানুষ চিকিৎসা পাব না। কেননা টাকা নেই বলেই তো আমরা সরকারি হাসপাতালে আসি। ডাকার পরেও আজ ডাক্তার না আসায় আমার পাশের সিটের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। আমরা তো এখন আতঙ্কের মধ্যে আছি, কখন কী হয়ে যায়।

নিহত মুসাফিরের মা রুবিনা বেগম আজকের প্রসঙ্গকে বলেন, "অনেকবার বলার পরেও স্যালাইন লাগিয়ে দিয়ে যায় নাই। এরপর আমার বাবুর অবস্থা খারাপ হলে আমি আবার গেলে একটি ওষুধ লিখে দিয়েছে, ওই ওষুধ খাওয়ানোর পরে আমার মুসাফির আরও অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। এরপর আমি আবারও নার্সকে জানালে আয়া এসে অক্সিজেন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। এরপরও আমার মানিক সুস্থ্য না হলে আবারও গিয়েছি। এরপর নার্স আমাকে ডাক্তার ডাকার পরামর্শ দিয়েছেন। একাধিক বার ডাক্তার ডাকলেও ডাক্তার আর আসেনি। আমার মানিক আমাকে রেখে চলে গেছে। হাসপাতালে এসেও বাঁচাতে পারলাম না।"

শিশুটির বাবা রাজিব শেখ বলেন, ডাক্তারকে আমি একাধিকবার ডাকলেও সে আমার কথায় গুরুত্ব দেয়নি। পরে নার্সকে জানালে নার্স আয়াকে পাঠিয়েছে। এরপরও ডাক্তার না আসায় নার্স নিজে গিয়ে ডেকেও ডাক্তার আনতে পারেনি। আমার বাচ্চা মারা গেছে। ডাক্তার আসলে আমার বাচ্চা মরত না। সদর হাসপাতালে রোগী মেরে ফেলে। আমি চাই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যেন আর কোনো বাবা সন্তান হারা না হয়।

হাসপাতালটির সিনিয়ির স্টাফ নার্স সীমা বৈদ্য বলেন, আমি দেখলাম যে বাচ্চার পেট ফুলে গেছে। রোগীর স্বজনদের চিকিৎসক ডাকার পরামর্শ দিয়েছিলাম। স্বজনদের ডাকে চিকিৎসক সাড়া না দেওয়ায় আমি ওয়ার্ড বয়কে দুইবার পাঠিয়েছিলাম, এরপরও দায়িত্বরত চিকিৎসক আসেননি। এরপর আমি আয়াকে পাঠিয়েছি, চিকিৎসক আয়াকে বলেছিলেন অক্সিজেন খুলে তার কাছে নিয়ে যেতে। বাচ্চার অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমি অক্সিজেন খুলতে রাজি হইনি। এরপর আমি নিজেই চিকিৎসককে ডাকতে যাওয়ার পর চিকিৎসক আমাকে একই কথা বলেছেন। এরপর শুনেছি বাচ্চার স্বজনরা কান্না করছেন। ততক্ষণে শরীফ স্যারের দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে, এরপর অন্য চিকিৎসক আসলে তিনি এসে দেখেছেন বাচ্চাটি মারা গেছে।

বিষয়টি নিয়ে জানার জন্য চিকিৎসক শরীফ উর রহমানকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। এর আগেও আপনার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ছিল, এই বিষয়ে জানতে চাওয়ার পরেও তিনি বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা। হাসপাতালে আপনার পদবী কী, এই প্রশ্নের উত্তরেও তিনি বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা।

চিকিৎসক শরীফ উর রহমানের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে জানতে চাইলে সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মিতু আক্তার বলেন, আমি হাসপাতালের অন্য স্টাফদের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরেছি। তার বিরুদ্ধে এর আগেও একই অভিযোগ পেয়েছি। আমরা একটি তদন্ত কমিটি করব, তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।