বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫

ঢাকায় এত গরম কেন? রহস্য জানুন!


২৩ এপ্রিল ২০২৪, ৬:০০ অপরাহ্ণ 

ঢাকায় এত গরম কেন? রহস্য জানুন!
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

বছরের শুরুতেই প্রকৃতি যেন রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেশ জুড়ে প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে জনজীবন। গত কয়েকদিন ধরেই ১ থেকে ২ ডিগ্রি করে বাড়ছে তাপমাত্রা। আবহাওয়া ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে দায়ী অধিক জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলা। শহরের সবুজ মাঠ, খোলা জায়গা ও পুকুর খাল ধ্বংসের কারণে প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে গরমের অনুভূতি কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অনুভূত হচ্ছে।

আবহাওয়াবিদরা  আরও বলেছেন, সাধারণত এপ্রিলে ঢাকার গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৯৬৫ সালে এপ্রিল মাসে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ১৯৬০ সালে ঢাকায় পারদ উঠেছিল রেকর্ড ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

প্রচণ্ড গরমে ঢাকার রাস্তা

সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন

কীভাবে বুঝবেন হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন

গরমে শরীর ঠান্ডা রাখার উপায়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি স্থানীয় অনেক কারণও রয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে তাপমাত্রা ভিন্ন অনুভূত হয়। সবুজের অভাব এবং ঘরের ছাদে টিন ব্যবহারের কারণে দরিদ্রতম এলাকাগুলোয় বেশি গরম। এগুলো দিনের বেলা সূর্যের তাপ ধরে রাখে এবং রাতে খুব দ্রুত তাপ ছাড়ে না। এই অঞ্চলগুলো উঁচু ভবনবেষ্টিত হওয়ায় সহজে বাতাস প্রবাহিত হয় না। এজন্য গরম বাতাস বাইরে বের হতে পারে না।

তীব্র গরমে নাজেহাল রাজধানীবাসী। বাইরে বেরুলেই গা জ্বালাপোড়া করে। কেমন যেন এক অসহনীয় অবস্থা যা চোখে দেখে অনুমান করা সত্যি অনেক কঠিন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের বিপর্যস্ত অবস্থা। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন দারুন বিপাকে। তাঁরা বলছেন, গরমে শুধু যে কষ্ট হচ্ছে তা নয়, রোজগারও কমেছে বেশ।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রিজিলিয়ান্স সেন্টারের ‘হট সিটিজ, চিল্ড ইকোনমিক: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিজ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রতি বছর ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রার ফলে ঢাকার মানুষের শ্রম উৎপাদনশীলতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকায় এরই মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিমাণ ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে চলেছে।

প্রচণ্ড গরমে ঢাকার সড়ক

গবেষকরা বলেন, গত ছয় দশকে শুধু ঢাকায় তীব্র এবং অসহনীয় গরমের দিনের সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। ‘চেঞ্জেস ইন হিউম্যান ডিসকমফোর্ট অ্যান্ড ইটস ড্রাইভার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৬১ সালে ঢাকায় সারা বছরে আরামদায়ক দিনের সংখ্যা ছিল ৮০। আর তীব্র গরমে কষ্টকর দিনের সংখ্যা ছিল ৭।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা অনুযায়ী,  গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার উধাও হয়ে গেছে। এ সময় প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার সবুজের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯৫ সালে রাজধানীতে জলাধার ও জলাভূমি ছিল ৩০ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে তা মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ জলাধার ও ৭ দশমিক ৯ শতাংশ সবুজ রয়েছে।

আরও পড়ুন

হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়

তিতা করলা খাওয়ার উপকারিতা

বিআইপির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যে কোনো শহর এলাকায় কংক্রিটের শতকরা হারের পরিমাণ হওয়া উচিত ৪০ শতাংশ, যা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। অথচ ঢাকার বেশিরভাগ জায়গায় কংক্রিটের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। কোনো কোনো জায়গায় তা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বারিধারা, বনানী, গুলশান, মহাখালী ও বাড্ডা এলাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার শতকরা হার ৮৮ দশমিক ৪ শতাংশ, সেই তুলনায় সবুজ মাত্র শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। এ ছাড়া মিরপুরের বড়বাগ, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও ইব্রাহিমপুর এলাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ৯৯ দশমিক ১৪ শতাংশ।

খিলগাঁও, গোড়ান, মেরাদিয়া, বাসাবো ও রাজারবাগ এলাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ৯৭ দশমিক ৬০ শতাংশ, সে তুলনায় সবুজ মাত্র শূন্য দশমিক ৯০ শতাংশ। পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাট ও বংশাল এলাকার শতভাগই কংক্রিট আচ্ছাদিত। সিদ্দিকবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ৯৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। সেই তুলনায় এসব এলাকায় কোনো সবুজ নেই, জলজ এলাকার পরিমাণও অতি নগণ্য।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয়- এ তিনটি কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বেড়েছে। বৈশ্বিক কারণের মধ্যে রয়েছে, পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজন ফরেস্ট নষ্ট হওয়া, উন্নত রাষ্ট্রগুলোয় কার্বন নিঃসরণ ও ফুয়েল বার্ন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়ছে। ঢাকা শহরের জলাধার বা পুকুরের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। জলাধার মাটির পরিবর্তে বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এটিও তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ঢাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি, যেটি প্রত্যক্ষভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।

গরমে-কষ্টের-দিন-পার-করছে-রিক্সাচালক

তিনি বলেন, ঢাকা শহরের পিচঢালা রাস্তা দিনের বেলা উত্তপ্ত হয় এবং রাতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে থাকে। এর পর যখন তা রিলিজ করে তখন তা নগরে তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বহুতল ভবনগুলোতে অতিরিক্ত গ্লাস এবং এসির ব্যবহারও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। ঢাকা শহরে তাপদাহের কারণে নভেল ভাইরাস ও প্যাথোজেনগুলোর বেঁচে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। এটি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ বাড়াচ্ছে। উচ্চ তাপমাত্রায় ডিহাইড্রেশন, অ্যালার্জি, হিটক্র্যাম্প, হিটস্ট্রোক দেখা দেয়। গ্রীষ্মকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং বর্ষাকাল অনেক দেরি করে আসছে।

আরও পড়ুন

গরমে যে সব খাবার আরও বেশি গরম করে তোলে

সজনে ডাঁটার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গাছ ও জলাশয় আছে এমন এলাকার চেয়ে ঢাকার তাপমাত্রা গড়ে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার। এসব যন্ত্রের ব্যবহার যতই বাড়ছে, ভবনের বাইরের এলাকার তাপমাত্রা ততই বাড়ছে। দেশের আবহাওয়া বিভাগের হিসাব মতে, গত ১০০ বছরে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় রাজধানীর তাপমাত্রা দেড় গুণের বেশি বেড়েছে।

সবশেষে কথা হচ্ছে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে হলে উন্মুক্ত স্থানে বা রাস্তার দু'ধারে সবুজ বনায়ন বাড়াতে হবে। সেই সাথে অধিক জনসংখ্যা্র চাপ কমাতে হবে এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধে জুড়ালো পদক্ষেপ গ্রহনের উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া দখলক্রিত জলাধার সমুহ উন্মুক্ত করতে হবে। রাজধানীর বুক থেকে ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা সরাতে হবে এবং নতুন করে কেউ যেন কোন শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে না পারে সেদিকে নজর বাড়াতে হবে।