বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর, ২০২৫

বজ্রপাত কি? বজ্রপাত কিভাবে সৃষ্টি হয়


১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৩:৩৩ অপরাহ্ণ 

বজ্রপাত কি? বজ্রপাত কিভাবে সৃষ্টি হয়
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

বজ্রপাত কি? বজ্রপাত কিভাবে সৃষ্টি হয় তা আমাদের প্রতিটি মানুষকেই জানা দরকার আর তা না হলে, বজ্রপাতের মতো আকস্মিক দুর্ঘটনা থেকে আমরা আমাদেরকে সুরক্ষা দিতে পারব না। চলুন তাহলে জেনে নেই, বজ্রপাত সম্পর্কে বিস্তারিত-

প্রচণ্ড গরমে চারপাশ যখন উত্তপ্ত, তখন এক পশলা বৃষ্টি স্বস্তি এনে দেয় শরীরে। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে তীব্র গরম থাকে। এ সময়ে মাঝে মাঝে দেখা মেলে কালবৈশাখী ঝড়ের। ঝড় বা বৃষ্টি ছাড়াও বজ্রপাত খুব সাধারণ এক ঘটনা। গ্রীষ্ম-বর্ষায় আকাশে মেঘ জমলেই শুরু হয় গুরু ডাক। মেঘ আরেকটু ঘনিয়ে এলে শুরু হয় বজ্রপাত।

বজ্রপাত কি?

বজ্রপাত হলো বৃষ্টির সময় বৃষ্টিমাত্রা থেকে জমকালো বিদ্যুৎস্ফূর্জনের বিষয়। বৃষ্টিমাত্রা থেকে আকর্ষণের ফলে মেগনেটিক ফিল্ড গঠন হয় এবং এর পরিমাণ যখন অতিবাহিত হয়, তখন সুপারচার্জ হয়ে বিদ্যুৎস্ফূর্জন ঘটে। এই বিদ্যুৎস্ফূর্জনকেই বজ্রপাত বলা হয়।

বজ্রপাতে প্রজ্জলিত বিদ্যুৎস্ফূর্জনের ফলে আলো ও শব্দ উৎপন্ন হয় এবং এটি মানুষের জীবন ও সম্পদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু ঠিক কীভাবে বজ্রপাতের ঘটনাটি ঘটে?

বজ্রপাত কিভাবে সৃষ্টি হয়?

বজ্রঝড় বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের শুরুটা হয় বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে উপবৃত্তাকার পথে। নিজ অক্ষের ওপরও ঘুরছে প্রতিমুহূর্তে। এসব ঘূর্ণনের ফলে দেখা যায়, বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় পৃথিবীর কিছু এলাকায় সূর্যের আলো তুলনামূলক বেশি সময় ধরে পড়ে। অর্থাৎ দিনের দৈর্ঘ্য বড় হয়। বেশি মাত্রায় সূর্যের তাপ ভূ-পৃষ্ঠে পড়ায় পৃথিবীপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হয়। উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে বায়ুতে। উষ্ণ, আর্দ্র বায়ুর ঘনত্ব ঠান্ডা বাতাসের চেয়ে বেশি হওয়ায় দ্রুত ওপরে উঠে যায়। ঠান্ডা, শুষ্ক বাতাস পড়ে থাকে নীচে।

ওপরে ওঠার সময় বাতাসের জলীয়বাষ্প ধীরে ধীরে আরও ঠান্ডা হয়ে পরিণত হয় পানির ফোঁটায় তৈরি হয় মেঘ। এই পানির কণাসমৃদ্ধ বাতাস দ্রুত তাপ ছাড়তে থাকে চারপাশে। ফলে, মেঘ ওপরে উঠতে থাকে। মেঘের আশপাশের অংশে শক্তিশালী ও উর্ধ্বমুখী বায়ুপ্রবাহ তৈরি হয়।

এর প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয় বিশাল বজ্রমেঘ। খাতা-কলমে এ মেঘের নাম ‘কিউমুলাস নিমবাস’। এই মেঘ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উঁচুতে গিয়ে ঠেকতে পারে। এ উচ্চতা পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ক্রমে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে কমতে থাকে। কিন্তু এর বাইরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আর কমে না। বাড়তে থাকে। ফলে এখানে এসে অদৃশ্য এক তাপীয় দেয়ালে ঠান্ডা বাতাস ধাক্কা খায়। প্রচুর পরিমাণ মেঘ এখানে এসে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ঝড়ের মেঘের সাধারণ আকৃতি-নৌকা বা এনভিল আকৃতি গঠন করে এ সময়।

মেঘের মধ্যে যত বেশি জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়, ততই পানির ফোঁটাগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বড় হতে থাকে। ওপরের অংশে তাপমাত্রা কম হওয়ায় সেখানে পানি আরও শীতল হয়। ফলে জমতে থাকে বরফকণা। পানি ও বরফের এসব কণা যথেষ্ট ভারী হলে বৃষ্টি বা শিলাবৃষ্টি হিসেবে ঝরতে শুরু করে। তৈরি হয় শীতল বাতাসের এক নিম্নগামী স্রোত। এই বাতাস প্রচণ্ড গতিতে ছড়িয়ে পড়ে ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি অংশে। হঠাৎ করেই পরিবেশের তাপমাত্রা কমে যায়। তীব্র গরম থেকে মেলে স্বস্তি।

ওদিকে মেঘের মধ্যে চলে ইলেকট্রনের খেলা। বায়ুপ্রবাহের কারণে মেঘের অজস্র পানির কণা বরফের কণাগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত ঘষা খেতে থাকে। ফলে, পানি ও বরফের কণা থেকে ইলেকট্রন মুক্ত বরফের বড় বড় কণায় চলে যায়।

ওপরের দিকে ভারী ও ঋণাত্মক চার্জের কণা, ইলেকট্রন জড়ো হয়। আর এর বিপরীত, অর্থাৎ নিচের অংশে তৈরি হয় ধনাত্মক চার্জের রাজত্ব। মানে, মেঘের ওপর ও নিচের অংশ জমে বিপরীতধর্মী চার্জ। তৈরি হয় বিভব পার্থক্য। এ পার্থক্য যথেষ্ট পরিমাণ হলে হঠাৎ প্রচণ্ড তড়িৎ প্রবাহিত হয় উচ্চ বিভব থেকে নিম্ন বিভবের দিকে। ফলে প্রচণ্ড তাপ তৈরি হয়। এই তাপ ও তাপের কারণে সৃষ্ট কম্পন থেকেই তৈরি হয় শব্দ ও আলো। নিচ থেকে আমরা এ ঘটনাকে বজ্রপাত বলি। তবে, এটা ইন্ট্রা-ক্লাউড ধরনের বজ্রপাত। অর্থাৎ মেঘেই জন্ম, মেঘের মাঝেই এর ইতি।

মেঘের ঋণাত্মক চার্জ ভূ-পৃষ্ঠের ইলেকট্রনকেও আন্দোলিত করে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠে তৈরি হয় ধনাত্মক চার্জ। এখানেও একই ঘটনা। বিপরীত ধর্মী চার্জের কারণে তৈরি হয় বিভব পার্থক্য। পর্যাপ্ত বিভব পার্থক্যের কারণে ঘটে তীব্র তড়িৎ প্রবাহ। এবারে বিভব পার্থক্যের একটা প্রান্ত যেহেতু মাটিতে, তাই বজ্রপাতের মাটি পর্যন্ত আসতে অসুবিধা নেই। মূলত এ ধরনের বজ্রপাতের কারণেই ঘটে প্রাণহানি।

বজ্রপাতের সময় আলো ও শব্দ হওয়ার কারণ

বজ্রপাতের সময় আমরা যে আলো দেখতে পাই তা মূলত এই সরু চ্যানেলের আয়নিত পরমাণু থেকে বিকীর্ণ শক্তির তীব্র আলোক ছটা। এই সরু, আয়নিত ও বিদ্যুৎ পরিবাহী চ্যানেল তৈরীর সময় বায়ুর তাপমাত্রা প্রায় ২৭০০০° c এবং চাপ প্রায় ১০-১০০ গুন পর্যন্ত বেড়ে যায়। কিন্তু এই পুরো ঘটনাটি ঘটে এক সেকেন্ডের কয়েক হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ে। এ পরিবর্তন আশপাশের বাতাসকে প্রচন্ড গতিতে বিস্ফোরণের মতো সম্প্রসারিত করে। এর ফলে প্রবল শব্দ উৎপন্ন হয়। এই শব্দকেই আমরা বজ্রপাতের শব্দ হিসেবে শুনি।

পৃথিবীর সম্মিলিত চার্জ শূন্য (০) হলেও পৃথিবীর পৃষ্ঠে ও কেন্দ্রে ভিন্ন ভিন্ন চার্জ থাকে বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীর কেন্দ্রে তীব্র চাপ ও তাপ থাকে। আমরা জানি, কোনো পদার্থের পরমাণুতে থাকা ইলেকট্রন তাপ গ্রহণ করে নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে যায় এবং তাপ অনেক বেশি হলে তা কক্ষপথ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। ফলে পরমাণুটি ধনাত্মক আধানে পরিণত হয়। পৃথিবীর কেন্দ্রে তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকায় অনুরূপ ঘটে। ফলে পৃথিবীর কেন্দ্র ধনাত্মক চার্জ এবং ভূপৃষ্ঠে বা তার সামান্য নিচে থাকা বস্তুর পরমাণু ওই ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জ এ পরিনত হয়। এই ঋণাত্মক চার্জ এর সাথে ডিসচার্জ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য মেঘের উপরের পৃষ্ঠের ধনাত্মক চার্জ-ই ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে।

বজ্রপাতের শক্তি

ভূমি থেকে ৩ মাইল দূরত্বের বজ্রপাত ১ বিলিয়ন থেকে ১০ বিলিয়ন জুল শক্তি উৎপন্ন করে। বৈদ্যুতিক শক্তি পরিমাপক একক ‘কিলোওয়াট/ আওয়ার’। এ হিসেবে এ শক্তি ২৭,৮৪০ কিলোওয়াট/আওয়ার।

বাংলাদেশে একটি পরিবার গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ১০০-১৫০ ইউনিট (কিলোওয়াট-আওয়ার) বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। তার মানে একটি বজ্রপাতের বিদ্যুৎ শক্তি জমা করতে পারলে একটি পরিবার ১৮৫ মাস বা, প্রায় ১৫ বছর বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন।

চাইলে আপনিও বজ্রপাতকে ট্র্যাপে ফেলে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ লুফে নিতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে বজ্রপাত ঘায়েল করতে আপনি সময় পাবেন এক সেকেন্ডেরও কম। কারণ, বজ্রপাতের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে। তবে বসে নেই বিজ্ঞানীরা। বজ্রপাত থেকে উৎপন্ন বিপুল পরিমাণ তড়িৎ শক্তিকে ধারণ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এবং তা বাস্তবায়িত করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আমাদের দেশে বজ্রপাতের শিকার মানুষদের বড় অংশ কৃষক, যারা সবার মুখে অন্ন তুলে দিতে মাঠে যান। আর সেখানেই মরে পড়ে থাকেন। অথচ বিশেষজ্ঞরা সব সময়ই বলে আসছে- এসময় ঝড়-বৃষ্টিতে ঘরে থাকার বিকল্প নেই। আমাদের দেশের সরকার ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশে বজ্রপাত নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের মতে, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয় রয়েছে, যেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুই বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।