বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

তিন শতকের ঐতিহ্যের সাক্ষী নাটোরের উত্তরা গণভবন


তিন শতকের ঐতিহ্যের সাক্ষী নাটোরের উত্তরা গণভবন
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

দেশের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন, নাটোরের ঐতিহ্যবাহী দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি যা এখন উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতিফলন এ ভবনটি আজও সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে যেমন এটি প্রাচীন রাজবংশের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী তেমনি আধুনিক সংস্কৃতি ও পর্যটনের এক উজ্জ্বল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

উত্তরা গণভবনের ভিত্তি, প্রাচীন রাজবংশের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। নাটোরের রাজা রামজীবন এবং তার বিশ্বস্ত দেওয়ান দয়ারাম রায়ের হাতে প্রতিষ্ঠিত দিঘাপতিয়া রাজবংশের ইতিহাস প্রায় ৩শ বছর পুরোনো। ১৭০৬ সালে রামজীবনের কাছ থেকে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় জমিদারি লাভ করেন। এরপর রাজবংশের সদস্যরা বগুড়া, পাবনা, জামালপুর ও যশোর জেলার অনেকাংশ শাসন করেন।

১৮৯৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হয় নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে। যেখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি যোগ দেন। তবে ১২ জুন ১৮৯৭ একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প রাজপ্রাসাদকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।

ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের পর ১৯০৮ সালে, ১১ বছরের প্রচেষ্টায় রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় বিদেশি প্রকৌশলী ও শিল্পীদের সহায়তায় রাজপ্রাসাদটি পুনঃনির্মাণ করেন। মোঘল ও প্রাশ্চাত্য স্থাপত্যশৈলীতে নান্দনিক কারুকার্য ও আর্কিটেকচার নিয়ে পুনর্নির্মিত এই রাজপ্রাসাদ আজও তার অতীতের গৌরব ধারণ করে আছে। ৪১.৫০ একর জমির উপর স্থাপিত এই রাজপ্রাসাদ বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য ও কারুকার্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে।

রাজপ্রাসাদে মোট ১২টি গুরুত্বপূর্ণ ভবন রয়েছে যার মধ্যে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, রান্নাঘর, ট্রেজারি বিল্ডিং, মটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার ইত্যাদি অন্যতম। রাজপ্রাসাদটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর বিশাল সিংহদ্বার এবং এক অদ্ভুত সুন্দর ঘড়ি যা এখনো সঠিক সময় জানিয়ে যাচ্ছে।

রাজপ্রাসাদটির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ইটালিয়ান গার্ডেনটি নিজের সৌন্দর্য এবং শ্বেতপাথরের ৪টি নারীর ভাস্কর্য দ্বারা মনোরম হয়ে ওঠে। এখানে রয়েছে ইটালিয়ান টাইপের ফোয়ারা, লৌহ ও কাঠের তৈরি বেঞ্চ এবং একটি ডিম্বাকার মার্বেল পাথরের মঞ্চ। এই বাগানটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শিল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে।

রাজপ্রাসাদের মূল ভবনটি একতলা, এর মধ্যে একটি বিশাল হলরুম রয়েছে যা উচ্চ গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। এই হলরুমটি রাজ আমলের সোফা ও ঝাড়বাতির সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক চিত্র তুলে ধরে। এর পাশেই রান্নাঘরের সাথে সংযুক্ত এক বড় ঘর যেখানে রাজা-মহারাজাদের প্রাসাদিক জীবনযাত্রার চিত্র প্রতিফলিত হয়ে উঠেছে। রাজপ্রাসাদের ভেতরের আসবাবপত্র, সিংহাসন ও রাজার শয়নঘর এখনও দর্শনার্থীদের মনোমুগ্ধ করে।

উত্তরা গণভবনের আকর্ষণের মধ্যে অন্যতম হলো তার নতুন গড়ে ওঠা সংগ্রহশালা। রাজবংশের ব্যবহৃত বিভিন্ন ঐতিহাসিক সামগ্রী, চিত্রকর্ম এবং অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। সংগ্রহশালার মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী পিতলের তৈরি যুদ্ধের বর্ম যা রাজা যুদ্ধে যাওয়ার সময় পরতেন। এছাড়া, একটি কালো কৃষ্ণ মূর্তি, রাজা প্রসন্ন নাথ রায়ের আবক্ষ মূর্তি ও একটি কালো কামানসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থান পেয়েছে এখানে।

রাজপ্রাসাদের পাশে একটি চিড়িয়াখানাও রয়েছে যেখানে হরিণ, বানর, ময়ুর, টিয়াপাখি সহ অন্যান্য প্রাণী দেখা যায়। সম্প্রতি স্থাপন করা হয়েছে পাখির অভয়াশ্রম যা প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখছে।

উত্তরা গণভবন দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য ১০ টাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য ২০ টাকা, সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য ৩০ টাকা এবং বিদেশি পর্যটকদের জন্য ৬০০ টাকা। জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে উত্তরা গণভবনে সংস্কার কাজের ফলে এবং নতুন সংগ্রহশালা, চিড়িয়াখানা, পাখি অভয়াশ্রম স্থাপন করায় দর্শনার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে, ঈদের দিন বা পিকনিকের মৌসুমে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায় অনেকগুণে।

উত্তরা গণভবনটি শুধু ঐতিহাসিক স্থাপত্যের একটি সাক্ষী নয়, এটি বাংলাদেশের গৌরবময় অতীত, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।