
তথ্য চাওয়ায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা
২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১:৫৫ অপরাহ্ণ
ট্রাফিক আইন মেনে চলুন এ কথাটি আমরা হরহামেশাই শুনে থাকি। কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবত সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যাও। সেইসাথে বৃদ্ধি পেয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, অকালে ঝড়ে যাচ্ছে হাজারো প্রাণ।
যদিও সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির মত বাংলাদেশেও রয়েছে ট্রাফিক আইন। কিন্তু আমরা সড়কে মোটরগাড়ি চালানোর সঠিক আইন মেনে না চলার প্রবণতাই মূলত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ।
আজকের প্রসঙ্গের আজকের আলোচনায় আমরা জানব, ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে কোন ধারায় কি শাস্তি রয়েছে এবং ট্রাফিক আইন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের কি করা উচিত?
সড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮৬০০টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। এরমধ্যে মারা যাচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। যাদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। সংস্থাটির দাবি, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষতির কথা বলার মতো নয়।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে এবং সড়ক পথে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে "মোটরযান আইন ১৯৮৩"বাস্তবায়ন করা হয়। এই আইনে কিছু নির্দিষ্ট বিধিমালা প্রণয়ন করে দেয়া হয়েছে। সেই বিধিমালা অনুযায়ী ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে নির্ধারিত কিছু শাস্তির মুখোমুখি হয়। আসুন জেনে নেই ট্রাফিক আইন ভঙ্গের শাস্তিগুলো কি?
১| (১৩৯) নং ধারায় হাইড্রোলিক হর্ন/নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার করলে ১০০ টাকা জরিমানা।
২| (১৪০/১) নং ধারায় আদেশ অমান্য করা, বাধা সৃষ্টি ও তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ৪০০ টাকা জরিমানা।
৩| (১৪০/২) নং ধারায় ওয়ান ওয়ে সড়কের বিপরীত মুখে গাড়ি চালালে ২০০ টাকা জরিমানা।
৪| (১৪২) নং ধারায় নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি বা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালালে ৩০০ টাকা জরিমানা এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে ৫০০ টাকা জরিমানা।
৫| (১৪৬) নং ধারায় থানায় যে সকল দুর্ঘটনা সংক্রান্ত অপরাধের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, সে সকল অপরাধে ৫০০ টাকা জরিমানা, পুনরায় একই অপরাধ করলে ১ হাজার টাকা জরিমানা।
৬| (১৪৯) নং ধারায় কেউ নিরাপত্তাবিহীন অবস্থায় গাড়ি চালালে ২৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
৭| (১৫০) নং ধারায় কোন যানবাহন থেকে কালো বা অতিরিক্ত ধোয়া বের হলে ২০০ টাকা জরিমানা।
৮| (১৫১) নং ধারায় মোটরযান আইনের সাথে অসঙ্গতি পূর্ণ অবস্থায় গাড়ি বিক্রয় বা ব্যবহার কিংবা গাড়ির পরিবর্তন করলে ২০০০ টাকা জরিমানা।
৯| (১৫২) নং ধারায় ফিটনেস সার্টিফিকেট বা রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট অথবা রুটপারমিট ব্যতীত মোটরযান ব্যবহার করলে ১৫০০ টাকা জরিমানা। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে ২৫০০ টাকা জরিমানা।
১০| (১৫৩) নং ধারায় অনুমোদনহীন এজেন্ট বা ক্যানভাসার নিয়োগ করলে ৫০০ টাকা জরিমানা এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে ১০০০ টাকা জরিমানা।
১১| (১৫৪) নং ধারায় গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মালামাল বহন অথবা অনুমোদিত ওজন অতিক্রম করলে ১০০০ টাকা জরিমানা, পুনরায় একই অপরাধ করলে ২০০০ টাকা জরিমানা।
১২| (১৫৫) নং ধারায় বীমা করা ব্যতীত কোন গাড়ি চালালে ৭৫০ টাকা জরিমানা।
১৩| (১৫৬) নং ধারায় অনুমতি ছাড়া গাড়ি চালালে ৭৫০ টাকা জরিমানা।
১৪| (১৫৭) নং ধারায় সড়কের মাঝে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
১৫| (১৫৮) নং ধারায় গাড়ির ইঞ্জিন, ব্রেক কিংবা অন্য কোন যন্ত্রাংশ অথবা গাড়ির বডি কিংবা স্পিড গভর্নর সিল অথবা টেক্সি মিটারের ওপর কোন অন্যায় হস্তক্ষেপ করলে ৫০০ টাকা জরিমানা।
১৯৮৩ সালে আইন প্রণীত হলেও উল্লেখিত শাস্তি সমূহের যথাযথ ব্যবহার ও সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। যার ফলে গাড়ি চালকরা ট্রাফিক আইন বা ট্রাফিক রুলস ভঙ্গ করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন না। এতে সড়ক দুর্ঘটনা কমার পরিবর্তে দিন দিন আরও বেড়েই চলছে।
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের তোপের মুখে সরকার সড়কের নিরাপত্তায় আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং ২০১৯ সাল থেকে "সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮" কার্যকর করা হয়। যা মূলত ১৯৮৩ সালের মোটরযান আইন অধ্যাদেশের সংশোধিত রূপ। নতুন এই আইনে ট্রাফিক আইন অমান্য করার শাস্তি বাড়ানো হয়েছে এবং শাস্তি গুলোর যথার্ত প্রয়োগের লক্ষ্যে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে।
১| ২০১৮ সালের নতুন সড়ক আইন অনুযায়ী ট্রাফিক সংকেত ভাঙার কারণে জরিমানা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
২| মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট পরিধান না করলে জরিমানা ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে।
৩| গাড়ি চালানোর সময় সিট বেল্ট না বাঁধলে কিংবা গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে চালককে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
৪| দ্রুতগতি বা বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে আহত করলে তিন লক্ষ টাকা জরিমান ও তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
৫| নতুন সড়ক আইনে চালকদের লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণী এবং চালকের সহকারীকে ন্যূনতম পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে।
৬| ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত কোনো মোটরযান বা গণপরিবহন ড্রাইভ করলে ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা ছয় মাসের জেল কিংবা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হতে পারে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ টি পয়েন্ট রাখা হয়েছে। আইন ভাঙলে জেল জরিমানা ছাড়াও সেখান থেকে পয়েন্ট কাটা যাবে এবং পুরো ১২ পয়েন্ট কাটা গেলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
এই আইনের ১৪ নং ধারার বিধান অনুযায়ী কন্ডাক্টর লাইসেন্স ছাড়া কোন ব্যক্তি গণপরিবহনের কন্ডাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা জরিমানা বা সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
৭| রেজিস্ট্রেশন ব্যতীত কোনো ধরনের মোটরযান চালনা করলে ১৬ নং ধারা অনুযায়ী চালককে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দন্ডে দণ্ডিত হবে।
৮| সড়ক আইনের ১৭ নং ধারা অনুযায়ী যদি কেউ ভুয়া বা জাল রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ব্যবহার ও প্রদর্শন করে তাহলে তাকে সর্বনিম্ন ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বনিম্ন এক লক্ষ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দন্ডে দণ্ডিত করা হবে।
৯| গাড়ির মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেস বা ইকোনমিক লাইফ অতিক্রান্ত বা ফিটনেসের অনুপযোগী অথবা ফিটনেস সনদ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান চালনা সংক্রান্ত ধারা ২৫ এর বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ছয় মাসের কারাদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
১০| সড়ক পরিবহন আইনের (২৮/১) নং ধারা অনুযায়ী দোষী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ২০,০০০ টাকা অর্থদণ্ড বা সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
১১| মোটরযান আইনের ৩১ নং ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি মোটরযানের বাণিজ্যিক ব্যবহার সংক্রান্ত কোনো বিধান লংঘন করলে এজন্য তাকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শাস্তি হিসেবে দোষ সূচক এক পয়েন্ট কাটা যাবে।
বাংলাদেশে নতুন আইন প্রণয়ন করা সহজ। কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। এত আইন থাকার পরও ট্রাফিক নিয়ম যথাযথ পালন করা হচ্ছে না এবং বেপরোয়া যান চলাচলও বন্ধ করা যাচ্ছে না। কিছু অসাধু চালক কিংবা পরিবহনমালিক জরিমানা দিয়ে কিংবা অসদুপায় অবলম্বন করে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেও ছাড়া পেয়ে যায় কিংবা সহজেই জামিন পেয়ে যায়।
দেশের সুনির্ধারিত আইন অমান্যকারী কোনো অপরাধী যেন সহজে ছাড়া না পায় সেজন্য প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং যথাযথ আইনের বিধান অনুযায়ী সাথে সাথে জরিমানা আদায় করতে হবে। সমাজের সকল স্তরের মানুষের মাঝে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।