
ভূতের মুখে রাম রাম, হাসিনাও এখন তত্ত্বাবধায়ক
২ সপ্তাহ আগে
৬ আগস্ট ২০২৫, ১২:৫৮ অপরাহ্ণ
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন | ছবি: পিআইডি |
![]() |
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে আয়োজন করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে আয়োজন করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে গতকাল রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এ কথা জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।’
ফেব্রুয়ারি বেশি দূরে নয় উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিতে নিতেই ভোটের দিন এসে পড়বে। বহু বছর আমরা কেউ ভোট দিতে পারিনি। এবার আমরা সবাই ভোট দেব। কেউ বাদ যাবে না। সবাই যেন বলতে পারি—নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে দেশকে রওনা করার জন্য আমি আমার ভোটটা দিয়েছিলাম। আমার ভোটেই দেশটা সে পথে রওনা হতে পেরেছিল।’
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সবার সহযোগিতা চেয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সবাই দোয়া করবেন যেন সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এ দেশের সব নাগরিক একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখরভাবে সম্পন্ন করা যায় সেজন্য সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করব। এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে। তার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করতে আগামীকাল (আজ) থেকে আমরা সবাই মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করব।’
নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচন আসছে। যদি আপনি আপনার নির্বাচনী এলাকা থেকে দূরে বসবাস করেন, তবে এখন থেকে নিয়মিত নির্বাচনী এলাকা পরিদর্শন করুন, যাতে সেরা ব্যক্তিকে নির্বাচিত করতে আপনি প্রস্তুত হতে পারেন। যাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের এ অতিমূল্যবান অধিকার ফিরে পেলাম, ভোটটা দেয়ার আগ মুহূর্তে যেন তাদের চেহারা আমাদের চোখে ভেসে ওঠে।’
নিজের প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করব। তবে নির্বাচনের আগে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ।’
জুলাই সনদ সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নাগরিক অধিকারের সত্যিকারের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামর্থ্যের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে বলে আশা প্রকাশ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে ভবিষ্যতের কোনো সরকারই যেন আর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে। রাষ্ট্রকে এমনভাবে মেরামত করতে হবে যাতে কখনো কোথাও ফ্যাসিবাদের লক্ষণ পাওয়া গেলেই সেটিকে যেন তাৎক্ষণিকভাবে সেখানেই নির্মূল করা যায়। আর যেন ১৬ বছরের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। বহু মানুষকে প্রাণ দিতে না হয়। আমাদের যেন আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজন না হয়।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের তিনটি দায়িত্ব ছিল—সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দেয়ালে দেয়ালে যে প্রত্যাশার কথা লিখে রেখেছিল, তার অন্যতম ফোকাস ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার। সে লক্ষ্যে আমরা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। তাদের মধ্যে প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে, সেগুলোর মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বহু সংস্কার আমরা এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছি।’
সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচার ব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে। এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান। আজ (৫ আগস্ট) এ মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’
প্রবাসীদের ভোট নিশ্চিত করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটারদের সম্পর্কে দু-একটা কথা বলতে চাই। এবার আমরা প্রবাসী ভোটারদের ভোট দেয়ার আয়োজন নিশ্চিত করতে চাই। অর্থনৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যে আবার দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে তার বড় কারণ হলো আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদান। নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
নারী ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আনতে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘নারী ভোটাররা যেন দেশের সর্বত্র নির্দ্বিধায় আনন্দ-উৎসাহ সহকারে তাদের ভোট দিতে পারে এটা নিশ্চিত করতে চাই। এবার যেন কেন্দ্রে কেন্দ্রে নারী ভোটারদের ঢল নামে সে লক্ষ্যে আমরা সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারকাজ ‘দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে’ মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বিচারের আনুষ্ঠানিক শুনানি পর্বও শুরু হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই।’ বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ তার সহযোগীদের বিচারের এ পুরো প্রক্রিয়া দেশবাসীর কাছে ‘স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান’ রাখার কথাও ড. ইউনূস উল্লেখ করেন তার ভাষণে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের একটা অংশও আমাদের দেশ। এর পরিমাণ মোট জমির পরিমাণের চেয়ে বেশি। বঙ্গোপসাগর আমাদের দেশের মূল্যবান অংশ, এ কথা সবসময় মাথায় রেখে অগ্রসর হব। এ অংশের পানির ওপর দিয়ে দেশ-বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করব। এর মাধ্যমে আমরা পুরো পৃথিবীকে আমাদের প্রতিবেশী বানাব। আর এ পানির মধ্যে আছে অফুরন্ত সম্পদ; মৎস্যসম্পদ থেকে শুরু করে আছে অফুরন্ত গ্যাস। এর সবকিছুকে নিয়েই আমাদের চিন্তাভাবনাকে চালিত করতে হবে।’
বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘উপকূল অঞ্চল অফুরন্ত সম্ভাবনার আধার। কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নানা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যে সমগ্র উপকূল অঞ্চলকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের সম্পদ ও পরিবেশের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। তারাও উৎসাহ সহকারে সাড়া দিয়েছে।’
বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত ড্রাইডক লিমিটেড নিউমুরিং টার্মিনাল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা কাজ শুরু করামাত্রই কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। প্রথম দুই সপ্তাহে দেখা গেছে আগের তুলনায় প্রতিদিন গড়ে ২২৫টি বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। এ বন্দরকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলা গেলে তা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখবে না; নেপাল, ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিনিময়ে তারাও উপকৃত হবে, আমরাও উপকৃত হব।’
এদিকে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার দেয়া ভাষণে নির্দিষ্ট করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে যে দোদুল্যমানতা ছিল, সেটি কেটে গেছে বলে মনে করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।
জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার দেয়া ভাষণের পর তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিক্রিয়ায় সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন। একটি জুলাই ঘোষণাপত্র, আরেকটি জাতির উদ্দেশে ভাষণের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা দুটোকেই স্বাগত জানাচ্ছি। এ ঘোষণার জন্য সারা জাতি অপেক্ষা করছিল। এখন নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যে একটি দোদুল্যমানতা ছিল, তা আর রইল না। এখন সারা জাতি নির্বাচনমুখী পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাবে। আগামী দিনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত হবে বলে আমরা আশা করি। সেই লক্ষ্যে সমগ্র জাতিকে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।’
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশে আরো বেশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগে কোনো রকমের অনিশ্চিত পরিবেশ আর থাকবে না। সবকিছু সচল হবে এবং গতিশীলতা পাবে।’