জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ গুণী শিক্ষক নির্বাচিত হলেন সুলতানা রাজিয়া
রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪
৮ জুলাই ২০২৪, ৪:৫৩ অপরাহ্ণ
ছবি/প্রথম আলো |
গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন |
এ তো জন্মের প্রবণতা, পাতালের কালো মাটিতে মাখানো শিশু—জীবনকে দেয় জীবনের হাতে তুলে,
এ তো উদাসীনতার এপ্রিলে পাওয়া যিশু।
ভালোবাসা কই?
এ তো ধর্মের চেয়ে প্রিয়।’
কবিতাটি লিখে শেষ করার পর আমার মনে হলো কে যেন আমার মাথার চুলে আদর করে বিলি কেটে দিচ্ছে। বলছে, ‘থামলে কেন? লেখো।’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি তখন আবার একটি কবিতা লিখতে শুরু করলাম:
‘গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল
আমাদের চারিধারে।
আমার কপালে একটা দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে কে যেন আমাকে বলল, ‘বাহ্ তুমি লেখো, আরও লেখো, আমি এখন যাই।’ ‘আমি যাই মানে? তুমি কে?’ ‘আমি মৈত্রেয়ী।’
দেয়ালের মতো অনুভূতিমাখা মোম
জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে আমরা দেখেছি
শিখার ভেতরে মুখ।
গতকাল ছিল জীবনের কিছু মরণের মতো সুখ।
গতকাল বড় যৌবন ছিল শরীরে শরীর লাগা—ফুলের বাগান ঢেকে রেখেছিল উদাসীন গাছপালা।
আমরা দুজন মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে
লুকিয়েছিলাম প্রেম,
গতকাল বড় ছেলেবেলা ছিল বুঝিনি কী হারালেম।
গতকাল বড় এলোমেলো চুলে
বাতাস তুলেছে গ্রীবা—
চুমু খেয়ে গেছে কৃষ্ণচূড়ার উজ্জ্বল মধুরিমা।
গতকাল বড় মুখোমুখি ছিল
সারা জীবনের চাওয়া।
চোখের নিমিষে চোখের ভেতরে চোখের বাহিরে যাওয়া।’
আমার কপালে একটা দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে কে যেন আমাকে বলল, ‘বাহ্ তুমি লেখো, আরও লেখো, আমি এখন যাই।’
‘আমি যাই মানে? তুমি কে?’
‘আমি মৈত্রেয়ী।’
‘তুমি এখানে এলে কী করে? আমি তো তোমাকে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম।’
মৈত্রেয়ী বলল, ‘নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে আমি তোমাকে অনুসরণ করে তোমার এই মেসে চলে এসেছি।’
‘কেউ দেখেনি তোমাকে?’
‘না, দেখবে কেমন করে। তুমিই দেখোনি যখন, তখন অন্য কেউ আমাকে দেখবে কেমন করে?’
‘তার মানে রেস্টুরেন্টে বসে আমি যে গানটি শুনেছিলাম, তুমিও শুনেছ সেই গান?’
মৈত্রেয়ী বলল, ‘শুনিনি শুধু, তোমার প্রিয় সুচিত্রার মতো ওই গানে আমি ঠোঁটও মিলিয়েছি।
‘এই গান আমারও কম প্রিয় নয় কবি। মাই মম স্যাং দিস সং মেনি টাইমস ফর মি। আই লাভ দ্যাট সং।’
আমাদের কথোপকথনের মধ্যেই হঠাৎ আমি দরজার খিল খোলার শব্দ পেলাম।
মনে হলো, কে যেন বেরিয়ে গেল আমার ঘর থেকে।
আমি ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না।
আমি নির্জন আলো–আঁধারি পথ ধরে সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। আজিমপুর কবরের গা ঘেঁষে যে সড়কটি বিডিআরের প্রথম গেট হয়ে নিউমার্কেটের সামনে দিয়ে মিরপুর রোডের সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হয়েছে, ওই পথ ধরে আমি অগ্রসর হলাম।
একবার আমি আমার মেসে ফিরে যাবার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু পায়ের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল না। নির্জন পথ ধরে এগোতে থাকলাম ভূতে পাওয়া পথিকের মতো। আমার জীবনানন্দের ওই কবিতার দুটো বিখ্যাত লাইন মনে পড়ল, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।’
পৃথিবীর পথে হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার পেছনের প্রেরণা তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, আমি জানি না। আমার মনে হলো, কী জানি, হয়তো বনলতা সেনের সন্ধানেই তিনি পথ হাঁটছিলেন। আমি যেমন ছুটে চলেছি মৈত্রেয়ীর সন্ধানে। কবিতা লেখার ঘোরের ভেতরে আমি যেমন মৈত্রেয়ীর উপস্থিতি ও স্পর্শ অনুভব করেছি, জীবনানন্দের বেলায় এমন কিছু ঘটেছিল কি? কে জানে!
স্ট্রিট লাইটের আলোয় পথের পাশের কৃষ্ণচূড়াগাছগুলো দেখা যাচ্ছিল। গাছগুলোর ফুলভারে নত ডাল থেকে কিছু কৃষ্ণচূড়া ছিঁড়ে নিলাম আমি।
মনে হলো, মৈত্রেয়ী অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাবার পর এই ফুলগুলোই তো বাংলাদেশে মৈত্রেয়ীর প্রতিনিধিত্ব করবে।
যত দূর চোখ যায়, আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম, কিন্তু একটি মানুষও আমার চোখে পড়ল না।
আমার মনে হলো, আই মাইট বি হ্যালুসিনেটেড বাই মৈত্রেয়ী।
এরই নাম হয়তোবা প্রেম, এরই নাম হয়তো কবির বিভ্রম। কে যেন আমার ভেতর থেকে আমাকে বলল, ‘এবার ফিরে যাও। গো ব্যাক টু ইয়োর হোয়াইট পেজেস অ্যান্ড রাইট ইয়োর পোয়েমস। বাট আই থিঙ্ক, ইউ নিড রেস্ট। ইউ শুড স্লিপ নাউ।’
ইংরেজি–বাংলা মিশিয়ে যে আমাকে এই কথাগুলো বলল, সে তো মৈত্রেয়ী ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না।
আমি মনে হয় ঠিকই বুঝেছি, মৈত্রেয়ীই এসেছিল। আমি তার প্রেমে পড়েছি কি না; পড়লে কতটা পড়েছি, তা যাচাই করে দেখার জন্য।
আমি বললাম, মৈত্রেয়ী, তুমি কোথায়? আমাকে দেখা দাও। আমাকে আলিঙ্গন করো। তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমি আমার আত্মার অগ্নিকে নির্বাপিত করি। আমি তো আপন অগ্নিতে ভস্ম হয়ে যাব।
কেউ আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। চারপাশ খুঁজে কাউকেই দেখতে পেলাম না আমি। অন্য অনেকবারের মতো তখন আবারও আমার মনে পড়ল সুচিত্রার গাওয়া একটি গানের দুটো কলি:
‘কে যেন আমারে ডাকে, অলখে লুকিয়ে থাকে
ফিরে ফিরে চাই, দেখিতে না পাই।’ (প্রথম আলো থেকে)