মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

জাপায় আটকে আছে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতা


১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ 

জাপায় আটকে আছে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতা

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির লোগো | ছবি: আজকের প্রসঙ্গ

  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট এবং নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতার বিষয়টি এখন জাতীয় পার্টির জন্য আটকে আছে। গতকাল রবিবার (১০ ডিসেম্বর) রাতে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেছে আওয়ামী লীগ। তাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, শরিকদের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত আসন ছাড়া বাকি আসনগুলো উন্মুক্ত থাকবে। সেখানে প্রতিটি দল তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করবে।

জাপায় আটকে আছে আসন সমঝোতা

বৈঠক শেষে ১৪ দলের নেতারা জানান, সব কিছু আলোচনা হলেও আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ সময় চেয়েছে। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, জাপার সঙ্গে আলোচনার আগে ১৪ দলের আসন ঠিক করতে চায় না দলটি। এর আগে গত শনিবার (০৯ ডিসেম্বর) জাতীয় পার্টির সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসে আওয়মী লীগ।

জাপার দাবি, আলোচনায় তাদের আসন থেকে নৌকার প্রার্থী সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি সম্মানজনক আসনে ছাড় দেওয়ারও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জাপার সঙ্গে বৈঠকে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের সঙ্গে আলোচনায় জোটের আসনে নৌকা প্রতীকে ভোটের কথা বলা হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।

আওয়ামী লীগ এত দিন চেয়েছিল এমনভাবে আসন সমঝোতা করতে, যাতে এই প্রক্রিয়া কোনোভাবেই নির্বাচনের ওপর ছায়া না ফেলে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসছে। জোট শরিক ও মিত্রদলের শর্ত মানতে হলে তাদের বেশ কিছু জায়গায় ছাড় দিতে হবে এবং তাতে সমঝোতার নির্বাচন তকমা পাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

তবে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল রবিবার (১০ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের বলেন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যেখানে আছে, সেখানে আসন ভাগাভাগি হয়। এটা অনেক দেশেই হয়।

১৪ দলের সঙ্গে বৈঠক

গতকাল রবিবার (১০ ডিসেম্বর) রাতে বৈঠক শেষে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেন, ১৪ দলীয় জোট একসঙ্গে নির্বাচন করবে। জোটের যাঁরা প্রার্থী হবেন তাঁরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। তবে জোটের আসন ভাগাভাগি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা আরও দু’এক দিন সময় চেয়েছেন।

হাসানুল হক ইনু বলেন, আসন বণ্টনের বিষয়টি তারা চূড়ান্ত করলে জোটের প্রার্থীদের তালিকা দেশবাসীকে জানানো হবে। রাজনৈতিকভাবে ১৪ দল একসঙ্গে আছে, একসঙ্গে নির্বাচন করবে। কোন দলের কে প্রার্থী হবেন, কোন আসন থেকে হবেন, সেই তালিকা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত আসনগুলো ছাড়া বাকি আসন উন্মুক্ত থাকবে। সেখানে প্রতিটি দল তাদের প্রতীকে নির্বাচন করবে।

জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আজকে একটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটা হচ্ছে আসন সমঝোতা। তারা (আওয়ামী লীগ) বলেছে আরও আলোচনা করবে। আমার কাছে মনে হয়েছে, তারা এখনো তালিকা প্রস্তুত করতে পারেনি। দলভিত্তিক চাহিদাপত্র তুলে দেওয়া হয়েছে, দু’এক দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত হবে আসন ভাগাভাগি।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এতে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম উপস্থিত ছিলেন।

শরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেমন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, গণতন্ত্রী পার্টির সভাপরি শাহাদাত হোসেন, গণ আজাদী পার্টির সভাপতি এস কে শিকদার ও বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৪ দলের বর্তমান শরিক দলগুলো হলো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল (এমএল), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, ন্যাপ (মোজাফফর), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ, রেজাউর), জাতীয় পার্টি (জেপি, মঞ্জু), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও গণ আজাদী লীগ।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, বৈঠকে আসন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা শেষ না হওয়ায় আসন বণ্টন করা যাচ্ছে না।

বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, শরিকরা বৈঠকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়টি আলোচনায় আনে। আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, নির্বাচন উৎসবমুখর করতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও দরকার।

জাপার সঙ্গে বৈঠক

আসন সমঝোতা নিয়ে গত শনিবার (০৯ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর গুলশানে আওয়ামী লীগ ও জাপার শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বৈঠক করেছেন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জাপার সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আযম। জাতীয় পার্টির পক্ষে ছিলেন দলটির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চৌধুরী ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের পর জাপা নেতারা দলীয় ফোরামে আলাদা বৈঠক করেন। সেখানে অন্য নেতাদের বৈঠকের বিষয়টি অবহিত করা হয়। বৈঠকে জাপার শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের জানানো হয়, আলোচনায় অগ্রগতি আছে। আসন ধরে ধরে আলোচনা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, প্রথম বৈঠকে জাপা কমবেশি ৭০টি আসন চাইলেও এখন তা কমিয়ে এনেছে। এখন কমবেশি ৫০ আসন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে ৩৫ থেকে ৪০টি আসনে সমঝোতা হলেই সন্তুষ্ট থাকবেন তাঁরা।

এর আগে গত বুধবার আসন সমঝোতা নিয়ে গুলশানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রথম বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে আসন সমঝোতার কৌশল নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু কৌশলটি কী তা স্পষ্ট করা হয়নি।

জাতীয় পার্টি সূত্র জানায়, নৌকার পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরাতে জাপা যে শর্ত দিয়েছিল তা নিয়ে শনিবারের বৈঠকে আলোচনা হয়। বৈঠকে জাপা নেতারা তাঁদের মনোনীত প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করার কৌশল জানতে চান। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নৌকার প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আনা হয়। জাপা এবারও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো কথা দেননি।

গতকাল রবিবার (১০ ডিসেম্বর) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির আলোচনা এখনো হয়নি। তবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের সমঝোতা স্বাভাবিক বিষয়।

জাপা সূত্র জানায়, যেসব আসনে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী আছে এবং যেখানে দলটির প্রার্থীদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে তারা ছাড় দিতে রাজি নয়। এ জন্য প্রত্যেক আসন ধরে ধরে কোন দলের কোন প্রার্থীর অবস্থা ভালো তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রায় ৪৫০ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ২৩ জন সাবেক সংসদ সদস্য। সাধারণত দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হলে সেটি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে শাস্তিযোগ্য বলে গণ্য করা হয়। তবে এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের উৎসাহিত করছে।

আওয়ামী লীগ বলেছে, তাদের দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লড়ছেন। সেখানে জোট শরিক ও মিত্রদের আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কিভাবে সরানো সম্ভব? তা ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলে নির্বাচনের আমেজ কমে আসবে। ভোটার উপস্থিতিতেও ভাটা পড়তে পারে।

জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে আতঙ্ক আছে। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়া কঠিন হবে বলে মনে করেন তাঁরা। সে জন্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মতো অবস্থান তৈরির বিষয়ে আওয়ামী লীগকে চাপ দিচ্ছে জাপা।

জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আলোচনা হবে। কারণ, আমরা একটা অর্থবহ, ভালো নির্বাচন চাই। সেটা করতে গেলে সময়ে সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারাও করে, আমরাও করি। ভোটাররা কিভাবে কেন্দ্রে আসবেন এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন, আমাদের আগ্রহের জায়গা এটা। যত বেশি ভোটার কেন্দ্রে আসবেন, আমাদের তত লাভ।