বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ গাইড কিভাবে যাবেন


২৭ নভেম্বর ২০২৩, ৪:২৪ অপরাহ্ণ 

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ গাইড কিভাবে যাবেন
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

সত্যিকার অর্থেই যদি বনভোজনের স্বাদ পেতে হয়, তাহলে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বন-জঙ্গলের কোনো বিকল্প নেই। অরণ্যের আনাচে-কানাচে কিছু পাহাড়ি টিলা উঁকি দিলে মন্দ হয় না। এমন প্রাকৃতিক নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় সিলেটের পথে বাংলাদেশের চা বাগানগুলোতে। আর তা যদি হয় বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বৃষ্টিবন এলাকা তাহলে তো কথাই নেই! বলছি দেশের ১০টি জাতীয় উদ্যান এবং ৭টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে অন্যতম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কথা। 

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল (আংশিক) উপজেলায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। জীব বৈচিত্রে ভরপুর নান্দনিক সৌন্দর্যের অন্যতম স্থান এই জাতীয় উদ্যানটি দেশে ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট হিসেবে খ্যাত। লাউয়াছড়া উদ্যান মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। চলুন, জেনে নেওয়া যাক- এই বুনো বাস্তুতন্ত্রে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়ার উপায়।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের নামকরণ

ভানুগাছ অঞ্চলে জুম চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ত্রিপুরা গ্রাম। ত্রিপুরা ভাষায় লাউয়াছড়া বনকে মৈলপতুইসা বলা হয়। মৈলপ মানে লাউ, আর তুইসা শব্দের অর্থ পাহাড়ি ছড়া। যে বনের ছড়ার ধারের জুমে লাউয়ের ফলন ভালো হয়, সেই এলাকাকে বলা হতো মৈলপতুইসা।
১৯২৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পুরো অঞ্চলটি অধিকার করে এখানে বৃক্ষায়ন শুরু করে। ইতোমধ্যে অরণ্যে রূপ নেওয়া মৈলপতুইসা ঘোষিত হয় সংরক্ষিত বন হিসেবে। ভানুগাছের পশ্চিমে থাকার কারণে এর নাম ছিল পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বন। ১৯২৭ সালে উপনিবেশিক বন আইন জারির পর এখানকার বিভিন্ন স্থানের নামে পরিবর্তন আনা হয়। আর এ সময়েই মৈলপতুইসা বদলে হয়ে যায় লাউয়াছড়া।

১৯৯৬ সালে ১৯৭৪-এর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংশোধন আইন অনুসারে বনের নামের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয় জাতীয় উদ্যান শব্দ দুটি।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনটির আয়তন প্রায় ২ হাজার ৭৪০ হেক্টর। এর ভেতরেই প্রায় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই মনোরম উদ্যান। কমলগঞ্জের ইউনিয়ন লাউয়াছড়ার অবস্থান ঢাকা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে। এখান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে সিলেট বিভাগীয় শহর। শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে লাউয়াছড়া মাত্র ৮ কিলোমিটারের পথ।

লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে যা দেখতে পাবেন

এই উদ্যান বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকা অবশিষ্ট চিরহরিৎ বনাঞ্চলগুলোর একটি। নিরক্ষীয় অঞ্চলের চিরহরিৎ অতিবৃষ্টি অরণ্যের আমেজটা এখানে পুরোটাই পাওয়া যায়। এখানকার গাছপালা খুব উঁচু হয়, এবং সেই অসামান্য উচ্চতায় ডালপালা ছড়িয়ে রীতিমত চাঁদোয়ায় রূপ নেয়। এই চাঁদোয়া ভেদ করে সূর্যের আলো পাহাড়ি মৃত্তিকার মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।

এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল উঁচু-নিচু টিলায় ভরপুর। মাটিতে বালুর আধিক্য ও প্রচুর পাথর একে দেশের অন্য সব বন থেকে আলাদা করেছে। পাতা জমে জমে পুরু স্পঞ্জের আস্তরণে ঢাকা থাকে এই মাটি। এলোমেলো গাছগাছালির মাঝ পথ দিয়েই এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকগুলো পাহাড়ি ছড়া। বনের মধ্যে চলার সময় এক ধরনের ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ সাইরেনের মত প্রায় সারাক্ষণই বাজতে থাকে।

এই উদ্যানে রয়েছে প্রায় ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ প্রাণী ও উদ্ভিদ। এর মধ্যে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং উদ্ভিদ ১৬৭ প্রজাতির। এগুলোর মধ্যে পর্যটকদের সেরা আকর্ষণ বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক। বর্তমানে লাউয়াছড়ার বনে সব মিলিয়ে মাত্র ৪৯টি উল্লুক অবশিষ্ট আছে।

অন্যান্য প্রাণীগুলোর মধ্যে হনুমান, মায়া হরিণ, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ, লক্ষী পেঁচা ও বনবিড়াল উল্লেখযোগ্য। বিশেষত লাউয়াছড়া উদ্যান শকুনের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র হিসেবে মনোনীত। উদ্ভিদের মধ্যে অকৃত্রিম পরিবেশে চোখ ধাঁধানো অর্কিড দর্শন প্রকৃতিপ্রেমিদের আচ্ছন্ন করে রাখে।

উদ্যানের পাশেই মাগুরছড়ায় চোখে পড়বে বন ও প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া খাসিয়াপুঞ্জি। তাদের থাকার জায়গাগুলো সিড়ির মতো একাধিক ছোট ছোট টিলা পেরিয়ে উপরে উঠে গেছে। নানা ফলের ক্ষেতের পাশাপাশি চোখ জুড়িয়ে দেয় তাদের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম পানের বরজগুলো। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পুরো উদ্যান ঘুরে দেখার জন্য তিনটি ট্রেইল রয়েছে। একটি ৩ ঘণ্টার, একটি ১ ঘণ্টার, আর আরেকটি আধ ঘণ্টার পথ।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

বছরের সব মৌসুমেই ঘোরার উপযোগী হলেও এখানে পর্যটকদের আনাগোনাটা বেশি হয় শীতকালে। পাহাড়ি ছড়ার ২ থেকে ৩টি ছাড়া প্রায় সবগুলোতেই শুধুমাত্র বৃষ্টির মৌসুমেই পানি থাকে। পানিশূন্য ছড়াগুলোতে বন্যপ্রাণীদের খুব একটা দেখা যায় না। তাই তাদের সাক্ষাত পেতে হলে আসতে হবে বর্ষাকালে। শুষ্ক মৌসুমে ভাগ্য ভালো থাকলে দুয়েকটার দেখা মিললেও মিলতে পারে।

চা-শ্রমিকদের কর্মব্যস্ত জীবনের সাক্ষী হতে চাইলে মে থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যেই এখানে বেড়িয়ে যেতে হবে।

ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল  

ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেনে দু’ভাবেই লাউয়াছড়া ঘুরতে যাওয়া যায়। তবে এর জন্য বাসের ক্ষেত্রে ফকিরাপুল, মহাখালি কিংবা সায়দাবাদ থেকে শ্রীমঙ্গলে আসতে হবে। এসি, নন-এসি ও বাস কোম্পানি ভেদে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৪৭০ থেকে ৬০০ টাকা।

ট্রেনে করে যেতে হলে ঢাকার কমলাপুর বা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশান থেকে শ্রীমঙ্গলগামী ট্রেনে উঠতে হবে। শ্রেণীর উপর ভিত্তি করে মাথাপিছু আসন খরচ হতে পারে ২৪০ থেকে ৮২৮ টাকা পর্যন্ত।

চট্টগ্রাম থেকে  শ্রীমঙ্গল

চট্টগ্রাম থেকে গ্রীনলাইন, এনা, সৌদিয়া ও লন্ডন এক্সপ্রেস সহ অন্যান্য পরিবহনে বেশকিছু বাস সিলেট যায়। এসি বাস ভাড়া ১২০০-১৪০০ টাকা ও নন-এসি বাসের ভাড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।

চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার পাহাড়িকা এবং উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে। শ্রেণী অনুযায়ী ট্রেনের টিকেটের মূল্য ৩৭৫ থেকে ১৩৩৮ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে বিমানে ঢাকা হয়ে সিলেট যাবার সুযোগ  রয়েছে।

শ্রীমঙ্গল থেকে লাউয়াছড়া উদ্যান কিভাবে যাবেন

শ্রীমঙ্গল থেকে লাউয়াছড়া উদ্যান যাওয়ার জন্য সিএনজি পাওয়া যায়। রিজার্ভ নিলে যাওয়া-আসা এবং উদ্যান ঘুরে বেড়ানোসহ ভাড়া নিবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। গাইড নিতে হলে ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মতো খরচ করতে হবে।

লাউয়াছড়া উদ্যানে প্রবেশমূল্য

ছাত্র ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উদ্যানে প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা। প্রাপ্ত বয়স্কদের বেলায় প্রবেশ মূল্য মাথাপিছু ৫০ টাকা। এই টিকেটের জন্য বিদেশী পর্যটকদের খরচ করতে হবে ৫০০ টাকা। নিজস্ব বা রিজার্ভ গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ২৫ টাকা দিতে হবে।

লাউয়াছড়ায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছা সড়কে চা বাগান ঘেঁষা বেশ কিছু কটেজ, সরকারি ও বেসরকারি গেস্ট হাউজ ও রিসোর্ট আছে। লাউয়াছড়া বন রেস্ট হাউজে থাকার জন্য বন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। লাউয়াছড়ার খুব কাছাকাছি পাঁচ তারকা মানের রিসোর্ট রয়েছে মাত্র দুয়েকটি।

বাংলো ধরণের কটেজগুলোতে কমপক্ষে ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৮ জন থাকা যায়। এগুলোতে প্রতি রাতের জন্য ভাড়া দিতে হবে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা। অন্যান্য মাঝারি ক্যাটাগরির হোটেলগুলোতে প্রতিষ্ঠান ও অতিথির সংখ্যা ভেদে ভাড়া ২ থেকে ১০ হাজার টাকা।

শ্রীমঙ্গলের রাধানগরেও দুটি ভালো মানের রিসোর্ট আছে। এছাড়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে কিছু বাজেট হোটেল আছে, যেগুলোতে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় রুম পাওয়া যেতে পারে। মৌসুম ও নানা ছুটির দিন উপলক্ষ্যে রিসোর্ট ও কটেজ গুলোর ভাড়ায় পরিবর্তন আসে। এ সময় বিভিন্ন ধরনের ডিসকাউন্টও পাওয়া যায়। লাউয়াছড়া উদ্যানের ভিতরে কিংবা আশেপাশে খাওয়া-দাওয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। 

ভ্রমণকারিরা উদ্যানে ঘোরার জন্য আগে থেকেই সঙ্গে করে হাল্কা খাবার নিয়ে আসেন। শ্রীমঙ্গলে নানা ধরণের মুখরোচক খাবারের রেস্তোরা আছে। এগুলোতে হাল্কা, ভারি সব মিলিয়ে বিভিন্ন পদের খাবার  ১০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যাবে।

লাউয়াছড়া বন-জঙ্গলে ভ্রমণে কিছু সাবধানতা

১. ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার পূর্বেই সঙ্গে করে প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র, পোকামাকড় নিরোধক এবং বিশুদ্ধ খাবার পানি সঙ্গে নিয়ে নিতে হবে।

২.শীতকাল ছাড়া অন্য সময়গুলোতে ভ্রমণের বেলায় জোঁক, লাল পিপড়ে ও সাপের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। চলাচলের সময় ভাল ভাবে চারপাশটা বিশেষ করে ছড়াগুলো খেয়াল করতে হবে।

৩. পরিবার, বন্ধু-বান্ধব দল বেঁধে যাওয়াটাই উত্তম। এতে নিরাপত্তার দিকটাও ঠিক থাকে, পাশাপাশি ভ্রমণ খরচটাও কমে আসে। তবে আনন্দের আতিশয্যে স্থানীয় লোকজন ও বন্য প্রাণীদের কোনো রকম ক্ষতি করা যাবে না। দলচ্যূত হয়ে পথ চলা বা বনের গভীরে যাওয়া যাবে না। একদম নবাগতদের জন্য গাইড সঙ্গে নিয়ে নেওয়া উত্তম।

৪. বনের যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না এতে বনের জীব বৈচিত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।

৫. বনের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনটির দেশ-বিদেশে অনেক খ্যাতি আছে। এই রেলপথ ধরে হাটার সময় ট্রেনের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।

৬. যাতায়াত এবং হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে আগে থেকে ভালো ভাবে দরদাম করে নেওয়া উচিত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তাতে যেন মার্জিত আচরণ বজায় থাকে।

শেষাংশ

দেশের ভেতরেই রেইন ফরেস্টের অসামান্য অভিজ্ঞতার নামান্তর এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ। বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল এরকম বনাঞ্চলে ভরপুর থাকলেও এই ভানুগাছের বিষয়টি একদমি আলাদা। বিশেষ করে যারা ছবি তুলতে পছন্দ করেন এই বিচিত্র বুনো জীবন তাদের জন্য স্বর্গতুল্য। সদ্য আসা আগন্তুক দলের অবাক দৃষ্টি প্রাণীগুলোর চাহনিতেও যেন বিস্ময়ের খোরাক যোগায়। গভীর চোখগুলো যেন খুঁজে চলে চিরচেনা খাসিয়াদের সঙ্গে এই নবাগতদের পার্থক্য।