শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

আজ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস


ধরুন কেউ আপনার কাছে কোনো মানুষ একটি ভিডিও দিলো। ভিডিও দেখে আপনি অবাক। অশ্লীল এক ভিডিওতে আপনাকে দেখা যাচ্ছে; চেহারা, ভয়েস, এক্সপ্রেশন অবিকল আপনার। আপনি জানেন ভিডিও’র ব্যক্তি আপনি নন। অথচ ভিডিওটি এতটাই বাস্তব যে আপনার নিজেরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে, ভিডিও’র ব্যক্তি আপনি নন। কিন্তু কী করে এটা সম্ভব? এটা সম্ভব ডিপফেক টেকনোলজি দিয়ে।

২৫ নভেম্বর ২০২৩, ৪:১১ অপরাহ্ণ 

আজ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস আজ। নারী নির্যাতন বলতে নারীদের ওপর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে কোনো ধরনের নিপীড়ন ও নির্যাতনকে বোঝায়। বলা যায়, নানা প্রেক্ষাপটে দিন দিনই বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা। পরিবার, সমাজসহ কোনো স্তরেই রেহাই পাচ্ছেন না তারা। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার দেশ ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত আন্দোলন করার জন্য প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল—এই তিন বোনকে হত্যা করা হয়। তারই স্মরণে দিবসটির উদ্ভব।

১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদযাপন কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস ও পক্ষ পালন করছে।

এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য "UNITE! Invest to prevent violence against women and girls".

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১১ সালের জরিপ মতে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।

জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন।

এ ছাড়াও বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জনে ৭ জন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ৭ শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। উন্নত-অনুন্নত সব দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র আরও অমানবিক।

কয়েক মাস আগের ঘটনা। অনলাইনে উদ্যোক্তা হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশি এক তরুণীর একটি অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যে ভিডিওটি মূলত সেই তরুণীর নয়। কোনো পর্ন সাইট থেকে নেওয়া ভিডিও ক্লিপে ডিপ ফেক টুলের মাধ্যমে তরুণীর মুখাবয়ব ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। পরে তিনি পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের সহায়তায় মূল ভিডিও শনাক্ত করতে সক্ষম হন। অপরাধীকে শনাক্ত করার বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন।

শুধু ওই তরুণী নন, ডিপ ফেক ছবি বা ভিডিওর কারণে অনেকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে। চলতি মাসের প্রথম দিকে ভারতীয় এক অভিনেত্রী এআইয়ের কারসাজিতে তৈরি ভিডিওর মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ভিডিও বা ছবি দেখে হৈচৈ বাধানোর আগে ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে হবে।

আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইডের ‘বাংলাদেশে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। অনলাইনে হেনস্তার শিকার সবচেয়ে বেশি ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েশিশুরা।

ভিডিওটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলেও ওই উদ্যোক্তা তরুণীর জীবনে এ ঘটনা বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এ বিষয়ে তরুণী বলেন, এখনো অনেকে ভাবেন, ভিডিওটি আমারই। সমবয়সীরা হয়তো বুঝতে পারে যে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে করা হয়েছে। কিন্তু মুরব্বি শ্রেণির লোকজন বোঝেন না। এতে শুধু আমি নই, আমার পরিবারও বিব্রত। একজন ভুক্তভোগী হিসেবে সবাইকে জানাতে চাই, এআইয়ের মাধ্যমে এখন এমন অনেক কিছু করা সম্ভব, যাতে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র বুঝতে পারে, কোনো মেয়ের এমন কোনো ভিডিও বা ছবি প্রকাশ পেলে ঘটনা যাচাই করে সত্যটাকে সামনে আনতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, নারী বা মেয়েশিশুরা হেনস্তার শিকার আগেও হয়েছে, এ যুগেও হচ্ছে। যেহেতু আমরা ডিজিটাইজেশনের যুগে প্রবেশ করেছি, তাই হেনস্তার বিষয়টি এখন বাস্তব জগতের পাশাপাশি ভার্চুয়াল জগতেও চলে এসেছে। অনলাইনে অপ্রাপ্তবয়স্ক বা শিশু-কিশোররাই বেশি হেনস্তার শিকার।

তিনি বলেন, এর কারণ হচ্ছে বোঝার মতো বয়স হওয়ার আগেই মোবাইল ফোনসেট, ল্যাপটপ ইত্যাদি শিশুদের হাতে যাওয়া। তারা তো জানে না যে এগুলো কী ভয়ংকর ফাঁদ! তারা নিজেদের ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে না বুঝেই শেয়ার করছে, কখনো-বা এসব মাধ্যমে পাতানো বন্ধুদের ব্যক্তিগত ইনবক্সে পাঠাচ্ছে। পরে নিজেদের বোকামির মাসুল গুনতে হচ্ছে। ভিডিও বা ছবিটি যে পাঠাচ্ছে, সে হয়তো সচেতন ছিল। কিন্তু যাকে পাঠাচ্ছে, সে হয়তো তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে ততটা সচেষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা প্রথমেই ভুক্তভোগীর দিকে আঙুল তুলি। অথচ আঙুল তোলা উচিত তার দিকে, যে ফাঁস করেছে বা যে এমন আপত্তিকর কিছু তৈরি করেছে।

তথ্য গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে বি এম মইনুল হোসেন আরও বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তৈরিই হয়েছে বন্ধু, পরিবার-পরিজন নিয়ে একটি গণ্ডি তৈরির জন্য। যেখানে ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ছবি ভাগাভাগি করে সংযোগে থাকা যাবে। এখানে ছবি বা ভিডিও যদি শেয়ার না করেন, তাহলে এটি ব্যবহারের উদ্দেশ্যই তো অসফল। তাই ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নিজেদের ছবি-ভিডিও শেয়ার করা বন্ধ করে নয়, বরং এসব নিয়ে যারা অশ্লীল, অনৈতিক কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

সাইবার ক্রাইম বা ইন্টারনেটে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘অন্তর্জাল’-এর চিত্রনাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আশা জাহিদ বলেন, এখন অনলাইনের নানা সফটওয়্যার ও প্ল্যাটফরম থেকে সহজেই ডিপ ফেক ভিডিও বানানো যায়। এ জন্য বিশেষ কোনো কোডিং শেখার প্রয়োজন হচ্ছে না। অনেক মোবাইল অ্যাপও আছে, যার মাধ্যমে ছবি থেকে ভিডিও তৈরি করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সিনেমার ক্লিপকে বিশেষভাবে সম্পাদনা করে ভিডিও বানানো যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, স্পাইডারম্যান বা আয়রনম্যান সিনেমায় নায়কের বদলে অন্য কারো চেহারা বসিয়ে ভিডিও তৈরি করা যাচ্ছে। প্রথম দিকে বিষয়টি আনন্দের মনে হলেও ধীরে ধীরে এসব ভিডিও বানানোর কৌশল বুলিংয়ে ব্যবহূত হচ্ছে। এসব ভিডিও সহজে শনাক্ত করার প্রযুক্তি নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।