উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী কুবি শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন মেরী
বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪
১১ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৫০ পূর্বাহ্ণ
কক্সবাজার রেলস্টেশন | ছবি: আজকের প্রসঙ্গ
গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন |
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হচ্ছে ট্রেন। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা, ঝাউবাগান পেরোনো বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, স্থবির নীল আকাশ আর সমুদ্রের টানা গর্জনের সঙ্গে মিশতে যাচ্ছে ট্রেনের হুইসল। তবে যাত্রী নিয়ে বাণিজ্যিক ট্রেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে চলবে ১ ডিসেম্বর এবং ঢাকা থেকে যাবে ২ ডিসেম্বর। আজ শনিবার (১১ নভেম্বর) চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত নির্মীয়মাণ রেলপথের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে রেল পাচ্ছে আরো ১০০ কিলোমিটার নতুন পথ।
সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারকে ট্রেন নেটওয়ার্কে যুক্ত করার ভাবনা ছিল ব্রিটিশদের, ১৮৯০ সালে। ১৩৩ বছর পর সেই ভাবনার বাস্তবায়ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। বিনিয়োগ সংকট, ভূমি অধিগ্রহণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো বড় বড় বাধা পেরিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে কক্সবাজার রেলপথ।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, আজ শনিবার (১১ নভেম্বর) সকাল ১১টায় কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। পরে ১৫টি কোচসংবলিত উদ্বোধনী ট্রেনে চড়ে রামু পর্যন্ত যাবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখান থেকে মহেশখালীতে আয়োজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দেবেন শেখ হাসিনা।
সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের পথে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচলের দিন এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র বলেছে, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে একটি ট্রেন বাণিজ্যিকভাবে চলাচল শুরু করবে। সেই ট্রেনের নাম ও সময়সূচি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
রেলওয়ে সূত্র বলছে, শুরুতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত একটি ট্রেন চলাচল করবে। ধীরে ধীরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়ে আট জোড়া করা হবে। যাত্রীপ্রতি কিলোমিটার হিসেবে ট্রেনের যা ভাড়া আছে সেটি বিবেচনা করেই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পথে ট্রেনের সর্বনিম্ন ভাড়া ১২৫ টাকা। আর সর্বোচ্চ ১৭২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা থেকে যেসব ট্রেন চট্টগ্রাম যায় তার সব কটিই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত যাবে। সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকেও আলাদা ট্রেন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত চলাচল করবে বলে জানায় রেল কর্তৃপক্ষ। নতুন এই পথে আন্ত নগর, লোকাল, কমিউটার—সব ধরনের ট্রেনই চলাচল করবে। ফলে শুধু ঢাকা বা দেশের অন্যান্য জেলার সঙ্গেই নয়, চট্টগ্রামের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগের নতুন পথ তৈরি হলো এতে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেন, বাণিজ্যিক চলাচলের জন্য যেসব প্রস্তুতি দরকার সেগুলো চলমান আছে। দ্রুতই সব গুছিয়ে এনে যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথের দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। এর সঙ্গে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত যোগ হলে ঢাকা থেকে পুরো পথের মোট দূরত্ব দাঁড়াবে ৪৬০ কিলোমিটার। তবে ভাড়া নির্ধারণের সময় এ পথের দূরত্ব ৫৩৫ কিলোমিটার ধরা হয়েছে। এই রেললাইনের মাধ্যমে ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে বাংলাদেশের। নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যটকদের আগের চেয়ে বেশি আকৃষ্ট করবে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের প্রতি। সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্য পরিবহন করাও সম্ভব হবে এই পথে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) রেললাইনের নির্মাণ প্রকল্পের মূল অনুমোদন পায় ২০১০ সালের ৬ জুলাই। ২০১৭ সালে প্রকল্প নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি শুরু হয়। প্রকল্পের কাজ গত বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি সাত লাখ টাকা সরকার দিচ্ছে। চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে। বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও তমা কনস্ট্রাকশন কম্পানি তাদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই প্রকল্প উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করায় সরকারের এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগ।
আইএমইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্মুক্ত দরপত্র না হলে কেনাকাটায় বেশি অনিয়ম হয়। দোহাজারী-কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত প্রকল্পের একটি অংশের কেনাকাটায় যে পরিমাণ বরাদ্দ হয়েছিল উন্মুক্ত দরপত্রে ঠিকাদারদের প্রতিযোগিতায় সেই খরচ ৪১ শতাংশ কমে গেছে। এটা আমাদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রকল্পের নির্মাণকাজের প্যাকেজ ১-এর লট ১-এ ক্রয় বাবদ প্রস্তাবিত বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। কিন্তু উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি হয় দুই হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে জি-টু-জি পদ্ধতিতে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় সেসব প্রকল্পে খরচ বেশি হয়। কারণ অর্থায়নকারী দেশের ঠিকাদাররা সরাসরি কাজ পায়। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় যেতে হয় না।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত ১০০.৮৩১ কিলোমিটার মূল লাইন, লুপ ও সাইডিং ৩৯.২০৫ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এতে ৩৯টি বড় সেতু, ২২৩টি ছোট সেতু, ৯৬টি লেভেলক্রসিং, হাতি চলাচলের জন্য এলিফ্যান্ট পাস (আন্ডারপাস ও ওভারপাস) নির্মাণ করা হয়েছে। তবে রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮.৩১৮ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। প্রকল্পের এই অংশেও রেলপথের সঙ্গে নির্মাণ করতে হবে ১৩টি মেজর ব্রিজ, ৪৫টি মাইনর ব্রিজ এবং ২২টি লেভেলক্রসিং। এ ছাড়া হাতি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হবে আন্ডারপাস ও ওভারপাস, সঙ্গে থাকছে দুটি নতুন রেলস্টেশন। সর্বশেষ অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রকল্পের মোট ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। স্টেশন ও রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ। তবে টেলিকমিউনিকেশন ও সিগন্যালিংয়ের কাজ এখনো বাকি আছে।
দোহাজারী-কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত রেললাইন চালু হলে গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতির। সেই সঙ্গে চাপ কমবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর। কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের পরিবর্তন ঘটবে। চাঙ্গা হবে পর্যটন ব্যবসা। নতুন করে বাড়বে স্থানীয় কর্মসংস্থান। আবার এই রেলপথকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় পণ্য পরিবহনের হাব তৈরি করতে চায় রেলওয়ে। সেখান থেকে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত একটি নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাতারবাড়ীর সমুদ্রবন্দরটি চকরিয়ার মাধ্যমে দেশের রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।
জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন নিয়মিত সেবাটা দিতে পারি। কারণ আমরা ভালো কিছু শুরু করার পর আর সেবা দিতে পারি না। সঠিক সেবা দিতে পারলে এই রেলপথ ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে আসবে। উন্নত যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সব সময় ব্যবসার প্রসারে ভূমিকা রাখে। ফলে এ জাতীয় বড় প্রকল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাণিজ্যে গতি বাড়বে।