
খুকৃবি গ্রেটার ময়মনসিংহ এসোসিয়েশনের দায়িত্বে সহকারী অধ্যাপক শরিফুল ও শিক্ষার্থী শাহীন
২৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১৯ অপরাহ্ণ
টানেল যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ। আজ শনিবার (২৮শে অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল ১১ টা ৪০ মিনিটে উদ্ধোধন করেন। উদ্ধোধন শেষে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি নিজের হাতে টোল দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল ত্যাগ করে অনুষ্ঠান সভায় উপস্থিত হন।
এক পাড়ে শহর। অন্য পাড়ে উপকূল! এক পাড়ে ঝলমলে আলো, অন্য পাড়ে অন্ধকার! বহু বছর ধরে কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়কে মানুষ চিনে আসছে এভাবেই। এই পার্থক্যের কারণে অর্থনীতি আর জীবনযাত্রার মানেও ছিল বহু পার্থক্য। এক পাড়ে গড়ে উঠেছে বন্দর, তেল শোধনাগারসহ কত শত স্থাপনা। অন্যপাড়ে ছিল ষোলকলা অবহেলা। অথচ দুই পাড়ের দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। এত কাছে, তবুও কত দূরে’র সেই দূরত্ব যেন মিটিয়ে দিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল।
বঙ্গবন্ধু টানেল চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর নিচে অবস্থিত সড়ক সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করছে। এই সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হয়েছে।
এর আগে জানা যায়, (২৮শে অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু টানেল সুড়ঙ্গ পথটি উদ্ভোধন করবেন। বঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু টানেল সুড়ঙ্গটি বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এই সুড়ঙ্গ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তের বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এই সুড়ঙ্গ নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তের চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে কর্ণফুলী সুড়ঙ্গ অবস্থান ১৫০ ফুট গভীরে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। যার নির্মাণের কাজ শুরু হলেও সর্বশেষ সংশোধিত বাজেটে, প্রকল্পের মেয়াদ ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয় এবং নির্মাণ ব্যয়ও ১৬৪ কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়।
বঙ্গবন্ধু টানেল সুড়ঙ্গ নির্মাণে ব্যয় হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং এর ঢাকা সফরে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসাবে দুই শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার।
কর্ণফুলী নদীর নিচে বঙ্গবন্ধু টানেল সুড়ঙ্গটি নির্মাণ কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। ২০২২ সালের মধ্যে সুড়ঙ্গটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ অব্যাহত ছিল৷ বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রতি টিউবের প্রস্থ ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা ১৬ ফুট। এছাড়া, দুটি টিউবের মধ্যবর্তী ব্যবধান ১১ মিটার। সুড়ঙ্গটির মূল দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। তবে এর সঙ্গে ৫.৩৫ কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক যুক্ত হয়েছে।
চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে কাছের উপজেলা হলেও আনোয়ারা-কর্ণফুলী যেন অনেকটাই পিছিয়ে ছিল উন্নয়নে। অথচ ১৯৯৫ সালের মহাপকিল্পনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) আনোয়ারা উপজেলাকে গ্রোথ সেন্টার হিসেবে উল্লেখ করে। সেই উপজেলা ঘিরে তাই নেওয়া হয় কয়েটি প্রকল্পও। কিন্তু পরবর্তীতে সেসবের বাস্তবায়ন হয়েছে খুব কমই। অবশেষে সেই গ্রোথ সেন্টারে উন্নয়নের ফসল ফলেছে বঙ্গবন্ধু টানেল। আনোয়ারা আর গ্রাম নয়, টানেলের কল্যাণে এখন উপশহর। কেননা বঙ্গবন্ধু টানেলর এক প্রান্ত যে পড়েছে এই প্রান্তেই।
সেসব তুলে ধরে এলাকাবাসীরা বলেন, একটা সময় আমরাই কাজের খোঁজে শহরে যেতাম। এখন আর সেই দৃশ্য নেই। এখন শহর থেকেই মানুষ আমাদের এখানে আসছে, কাজের জন্য। এ থেকেই বুঝে নিন বঙ্গবন্ধু টানেল আমাদের জন্য কি সুসংবাদ বয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে গোলকাটা এলাকায় গড়ে উঠেছে আনোয়ার মা-শিশু জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনিস্টিক সেন্টার নামের একটি চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা বলেন, একটা সময় কোনো অসুখ হলেই আমাদের দৌঁড়াতে হতো চট্টগ্রাম শহরে। কখনো ভাঙা সড়কে, কখনো নৌ পথে আমাদের বহু কষ্টে যেতে হতো। এখন টানেলকে ঘিরে আমাদের এখানেও গড়ে উঠছে হাসপাতাল। সেজন্য আমাদের দুর্ভোগও কমেছে।
বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে এক সময়ের অন্ধকারে ডুবে থাকা এলাকাটি এখন জেগে থাকবে ২৪ ঘণ্টা। সেই বিবেচনায় কালাবিবির দিঘী এলাকায় হোটেল খোলা হয়েছে। হোটেল মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একটা সময় সন্ধ্যা হলেই আমাদের এলাকা ঘুমিয়ে পড়ত। পথেঘাটে তেমন একটা মানুষও দেখা যেত না। এখন আর সেই দিন নেই। এখন ২৪ ঘণ্টাই মানুষের আনাগোনা। বঙ্গবন্ধু টানেল চালুর পর সেটি আরও বহুগুণ বাড়বে। সেজন্যে এখানে হোটেল চালু হয়েছে।’
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু টানেল প্রায় ৫০ হাজার একর জায়গায় তৈরি করবে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে আনোয়ারা প্রান্তে হবে অর্থনীতির নতুন দ্বার। এতবছর ধরে শিল্প কারখানার ৮৫ শতাংশই ছিল কর্ণফুলী নদীর চট্টগ্রাম শহর অংশের পাড়ে আর ১৫ শতাংশই ছিল আনোয়ারা পাড়ে। সেটি এখন সমতায় না আসলেও পার্থক্যটা কাছাকাছি চলে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু টানেলের আগে কারখানা ছিল মাত্র ১৫ শ একর জায়গায়। টানেলের পরে সেটি বহুগুণ বেড়ে ১২ হাজার একর জায়গায় পৌঁছাবে।
টানেলের আগে শিল্প কারখানা ছিল মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু টানেলের পর সেটি দাাঁড়াবে ২৪ শতাংশে। বাড়বে আবাসনও। এখন আবাসান আছে ১০ শতাংশ, সেটি বেড়ে দাঁড়াবে ২০ শতাংশে। শিল্প কারখানা আর আবাসনের দাপটে অবশ্য কমবে কৃষি ও মাছ চাষ। এখন কৃষি ও মাছ চাষ হয় ৪৭ শতাংশ। সেটি কমে নেমে আসবে ২১ শতাংশে। টানেলের কারণে দূরত্বও কমবে বহুগুণ।
শিল্প-কারখানার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে কর্মসংস্থানও। সম্ভাবত্য যাচাইয়ের সমীক্ষা বলছে, শিল্পায়ন ও যোগাযোগের সঙ্গে এখানে প্রতি বছর ১৭ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এতে কমবে বেকার। কমবে দারিদ্রতার হার। আর দেশের জিডিপিতে টানেলের অবদান হবে ০.১৬ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এইচ এম সেলিমুল্লাহ বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে অর্থনীতির ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, পণ্য সামগ্রীর সেবার উৎপাদন ও সরবরাহ বহুগুণ বেড়ে যাবে। এই অবদানগুলাকে যখন আমরা জিডিপিতে মোট মূল্য আকারে হিসাব করব, তখন জিডিপিতে টানেলের অবদানটা দেখব। সেটি আমরা হিসেব করে দেখছি একটা বিশাল একটা আকারের অবদান।
বঙ্গবন্ধু টানেলের কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনের সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি বলেন, একসময় আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছিল অবহেলিত। এখন আর সেটি নেই। টানেলসহ সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের কারণে এটিই এখন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি এলাকা।