রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪

রাবিতে বন্ধ হয়নি ছাত্রলীগের সিট বাণিজ্য


২৪ জানুয়ারী ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ণ 

রাবিতে বন্ধ হয়নি ছাত্রলীগের সিট বাণিজ্য
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

গত বছরের অক্টোবরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর আবাসিক হলগুলোতে সিট বাণিজ্য বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার থাকার সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি দেন তারা। তবে দায়িত্ব গ্রহণের পরেও আবাসিক হলগুলোতে বিভিন্ন কৌশলে নিয়মিত সিট বিক্রি করার অভিযোগ ওঠছে হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বিরুদ্ধে। সেই অর্থের ভাগ শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের আস্থাভাজনদের হাতে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।

শুধু তাই নয়, হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের সিট থেকে নামিয়ে দেওয়া, মাস্টার্স শেষ হওয়ার আগেই হল থেকে নেমে যাওয়ার জন্য চাপ ও হুমকি দেওয়া এবং শিক্ষার্থীকে মারধরসহ বেশ কিছু অভিযোগ ওঠছে ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে সিট বাণিজ্যের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার খোঁজ পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের আল আমিন পিয়াস নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীর কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড এ প্রতিনিধির হাতে এসেছে। অডিওতে পিয়াসের বক্তব্যে সিট বাণিজ্যের প্রমাণ ও টাকা ভাগাভাগির কিছু বিষয় উঠে এসেছে।

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মী আল আমিন পিয়াস শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর অনুসারী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিল আহম্মেদের সঙ্গে হল দেখাশোনা করেন বলে জানা যায়।

আল আমিনের বক্তব্য অনুযায়ী, শহীদ শামসুজ্জোহা হলের একটি আসন বর্তমানে আট হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে থাকেন তারা। সিট বিক্রির এই পুরো টাকা শাকিল আহম্মেদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে সেই টাকা কয়েকটি হাত ঘুরে শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে যায়।

অডিও রেকর্ডে আল আমিন পিয়াসকে বলতে শোনা যায়, ‘একটা সিটের বিনিময়ে ৮ হাজার করে দিতে হবে। এখন তো এরকম দাম। এর আগে তো ৭-৮ করেই চলতো... আমরাও ওই ৮ (আট হাজার) করে তুলতেছি। কিন্তু তোর সিটের গ্যারান্টি আমি দিব। তোর সম্পূর্ণ দায়ভার আমার। আমরা যে কাজ করবো, সেগুলো শিউর সট।’

এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমি তোকে শাকিল ভাইয়ের (হলের সাংগঠনিক সম্পাদক) সাথে সাক্ষাতে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিব। তুই সরাসরি কথা বলে হলে উঠে যাবি।’ এছাড়া তিনি আরও বলেন, হলের রুমওয়ার্ক, ছেলেদের প্রোগ্রামে ডাকা এবং কোন সিটগুলো খালি হচ্ছে শাকিলের অধীনে তিনিই দেখাশোনা করেন।

তবে এভাবে টাকার বিনিময়ে হলের আসন নিলে ‘সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা লাগবে না’ বলেও প্রতিশ্রুতি দিতে শোনা যায় তাকে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তোকে অ্যাকটিভলি পলিটিক্স করা লাগবে না। তোকে নন পলিটিকাল ব্লকে দিব। কোনো প্রোগ্রাম করতে হবে না। তবে ন্যাশনাল প্রোগ্রামগুলোতে শুধু অ্যাটেন্ড করবি। দশ মিনিট শুধু একটু দেখা দিয়ে চলে আসা। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো দিনগুলোতে যাওয়া লাগতে পারে।’ এ ছাত্রলীগ কর্মী নিজেও টাকার বিনিময়ে হলে উঠেছেন বলেও স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমার ক্ষেত্রে যেমন হইছে, আমি টাকা দিয়ে হলে উঠছি। কিন্তু পরে আমাকে পলিটিক্স করতে হচ্ছে। তোর ক্ষেত্রে এরকম হবে না।’

সিট বাণিজ্যের এ টাকার অংশ কয়েক ভাগে ভাগ হয় বলে জানা যায় অডিওর মাধ্যমে। তিনি বলেন, “শাকিল ভাই টাকা পাবে। আমি পাবো না। লোক আমি উঠালাম। শাখায় কিছু টাকা যাবে ‘মাল খাওয়ার’ জন্য। তবে শাকিল ভাই শেষে খুশি হয়ে আমাকে কিছু দিতে পারে।”

সিট বাণিজ্যের টাকার অংশ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর কাছে যাবে কিনা সেই বিষয়ে তিনি বলেন, “বাবু ভাই নিজে খাবে না, তার আশপাশের যে ‘চ্যালা’ (অনুসারী) আছে তারা হালকা কিছু রাখবে। আর কিছু শাকিল ভাইয়ের কাছে থাকবে। তবে আমাকেও কিছু দিতে হবে। কারণ ভাই তো একা হল চালাচ্ছে না, আমিও চালাচ্ছি। তবে টাকা শাকিল ভাইয়ের হাতে আমি পুরোটাই দিয়ে দিবো।”

তবে হলগুলোতে সিট বাণিজ্য না করার জন্য শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশনা আছে বলেও স্বীকার করেন আল আমিন পিয়াস। কথার এক পর্যায়ে টাকার বিনিময়ে হলে ওঠার বিষয়টি গোপন রাখার পরামর্শ দেন এ ছাত্রলীগ কর্মী। তিনি বলেন, ‘আমরাও খুব রেস্ট্রিকশনের মধ্যে আছি। বাইরের কাউকেই বলা যাবে না যে টাকা দিয়ে উঠছিস। তুই বলবি যে পলিটিক্যালি উঠেছি, কাহিনী শেষ।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ কর্মী আল-আমিন পিয়াস বলেন, ‘এগুলো সব মিথ্যে ইনফরমেশন। আমাকে ফাঁসানোর জন্য এগুলো করা হচ্ছে। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে যে আমরা সিট বাণিজ্য করেছি বা টাকার বিনিময় কাউকে তুলেছি তাহলে যে শাস্তি দেয়া হবে তা মাথা পেতে নেব।’ এদিকে বিষয়টি অস্বীকার করেন শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিল আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি হলে আছি। শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির অনুসারী আমরা যারা আছি তারা কেউ-ই সিট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত না।’

প্রমাণ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা হিল গালিব। তিনি বলেন, ‘যদি কারো বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্যের প্রমাণ থাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যদি ব্যবস্থা না নিতে পারি তবে আমার পদ থেকে সরে দাঁড়াবো। সিট বাণিজ্যের যে প্রমাণ আছে তা নিয়ে আমি শাখা সভাপতির সাথে কথা বলবো। তিনি যদি ব্যবস্থা না নেন তাহলে আমি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব। আর যদি সেটাও না হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে বিষয়টা অবহিত করবো।’

এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, ‘শাকিল এবং আল আমিন কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ওই হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মোমিন। সে হলে না থাকায় তারা হল দেখাশোনা করছে। তাদের বিরুদ্ধে এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করব।’