শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

বছর শেষে অর্থনৈতিক সংকটে হতাশায় ব্যবসায়ীরা


২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১:২৫ অপরাহ্ণ 

বছর শেষে অর্থনৈতিক সংকটে হতাশায় ব্যবসায়ীরা
  গুগল নিউজে ফলো করে আজকের প্রসঙ্গ এর সাথে থাকুন

মূল্যস্ফীতির চাপে কমেছে পণ্যের চাহিদা। বাজারে কমেছে বেচাকেনা। প্রকট ডলার সংকটে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে আমদানি। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি কমায় হ্রাস পেয়েছে শিল্পের উৎপাদন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনেকটা ভাটা পড়েছে। বর্তমান এই অর্থনৈতিক সংকটে শিল্পের চাকার স্লথগতির কারণে চাপে আছেন ব্যবসায়ীরা।

একদিকে নতুন বিনিয়োগ করে প্রত্যাশিত আয় করতে পারেননি উদ্যোক্তারা, উল্টো রয়েছে উচ্চসুদে ঋণ পরিশোধের চাপ। এমন পরিস্থিতি থেকে শিগগিরই উত্তরণের উপায় দেখছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে তাঁদের কপালের ভাঁজ গাঢ় হচ্ছে।

এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, বিদ্যমান বিনিয়োগ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। করোনাকালীন সংকট মোকাবেলায় সরকার সহায়তা দিলেও বর্তমান সংকট উত্তরণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সব পর্যায়ের ব্যবসা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের সহায়তা আশা করছেন তাঁরা।

ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিনিয়োগ এবং শিল্পের উৎপাদন এখন পুরোটাই স্থবির হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ। তিনি বলেন, ডলার সংকটে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কমিয়ে কারখানা কেবল চালু রাখার হচ্ছে। এতে ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাওয়ার পাশাপাশি অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য।

ভবিষ্যৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতিও আসন্ন নির্বাচনের ওপর অনেকটা নির্ভর করছে। আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকারের নীতি সহায়তার ওপর নির্ভর করবে আগামীর ব্যবসা-বাণিজ্য। আপাতত ব্যবসা-বাণিজ্য অনিশ্চয়তার মধ্যেই আছে।

ডলার নিয়ন্ত্রণের চাপে ব্যবসা

দীর্ঘদিন ধরে ডলার সংকট ও ডলারের চড়া দামের চাপে আছেন ব্যবসায়ীরা। আবার রিজার্ভ ঠিক রাখতে সরকারের নেওয়া কঠোর নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রায় সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে একরকম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। নতুন বিনিয়োগে গড়া শিল্পে কোনো গতিই আসেনি। আমদানিনির্ভর শিল্পের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এতে নতুন কর্মসংস্থানের গতিও থমকে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের মে মাসে ডলারের দাম ছিল গড়ে ৮৬ টাকা। আর এখন ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১১ টাকা। এই সময়ে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ টাকা। চলতি বছরের শুরুতে ডলারের গড় দাম ছিল ১০০ টাকা। এ বছর এখন পর্যন্ত বেড়েছে ১১ টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই দামে ডলার পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।

খোলাবাজারে এই ডলারের দাম চলতি বছরে ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এখনো আমদানি করতে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২৩ টাকা ব্যয় হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের আরও বেশি দাম দিতে হচ্ছে। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

ডলার সংকট মোকাবেলায় গত বছরের এপ্রিল থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। জুনে নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয়। আগস্টে ডলারের সংস্থান ছাড়া ঋণপত্র (এলসি) খোলা বন্ধ হয়ে যায়। ওই সময় থেকেই টানা এখন পর্যন্ত রপ্তানিকারক ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের এলসি খোলা যাচ্ছে। অন্যান্য পণ্যে অনুমতি সাপেক্ষে এলসি খোলা যাচ্ছে।

সীমিত আমদানি, কমেছে শিল্প উৎপাদন

আমদানিনির্ভর শিল্পে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শিল্পে কাঁচামালসংকটে পণ্যের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এসব শিল্পে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক শিল্প কাঁচামালসংকটে বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এগুলোতে কর্মরত শ্রমিকরাও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে শিল্প খাতের পণ্য ও কাঁচামালের আমদানি ও এলসি খোলা দুটিই কমেছিল। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে মোট আমদানি কমেছে ২৭.৩৬ শতাংশ। শিল্প খাতের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে ৯ শতাংশ। একই সময়ে মোট আমদানি ব্যয় কমেছে ১৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর এই আমদানি ব্যয় কমানোয় সংকুচিত হয়েছে শিল্প খাতের প্রসার।

এনার্জিপ্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী হুমায়ুন রশিদ বলেন, গত এক বছরে বিদ্যুৎ-জ্বালানিও মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবের সঙ্গে রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব তেমনভাবে আমাদের ওপর পড়েনি। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের আয় কমেছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। তিনি বলেন, আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ এলসি খুলতে পারিনি। ফলে আমদানি কম হয়েছে, কর্মসংস্থান কমেছে, রপ্তানিও কমেছে। ফলে কর আহরণ কম হয়েছে। তিনি বলেন, সামনের দিনে আমরা পরিস্থিতির উত্তরণের কোনো লক্ষণ দেখছি না। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে ঢেলে সাজানো।

এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে ছোট ও মাঝারি শিল্প। এসব শিল্প নিজেরা কাঁচামাল আমদানি করতে পারে না। তারা অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে উৎপাদন করছে। আর তাদের চাহিদার জোগান দেন বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা। তাঁরা এখন শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করে সরবরাহ করতে পারছেন না। এতে বড় সংকটে পড়েছে এসএমই খাত। ভালো অবস্থায় নেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের বাইরে থাকা বড় শিল্পগুলো। তারাও এখন চাহিদামতো যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না।

ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমার প্রভাব রপ্তানিতে

চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই খাতের ব্যাক টু ব্যাক এলসি কমেছে সাড়ে ১০ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২৯ শতাংশ। এর প্রভাবে রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন কম হবে। ফলে রপ্তানি কমবে। এরই মধ্যে রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, জুলাই-সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় এসেছে ৯৯০ কোটি ডালার। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় এসেছিল এক হাজার ২৩২ কোটি ডলার। ফলে রপ্তানি কমেছে ২৪২ কোটি ডলার। বর্তমানে শিল্পের স্থবিরতায় রপ্তানি আয় কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ী আনোয়ারুল আলম চৌধুরী।

শিল্পের অন্যতম উপকরণ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতেও আমদানি কমেছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ায় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্যাসের আমদানিও কম। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে জ্বালানি পণ্যের এলসি কমেছে সাড়ে ১২ শতাংশ, আমদানি কমেছে ২০ শতাংশ।

জ্বালানি খাতে আমদানিতে ভর্তুকি দায় পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো। ডলার সংকটে তারাও আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে পারছে না।

আমদানি কমার প্রভাব শিল্পে

গত অর্থবছর থেকেই শিল্পের যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে। এতে নতুন বিনিয়োগ করেও কারখানা চালু করতে পারেননি অনেকেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি এলসি কমেছে ২৩.৯৩ শতাংশ। আমদানি কমেছে ৩৯.৭২ শতাংশ। এতেও নতুন শিল্প স্থাপনে নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বস্ত্র খাতের যন্ত্রপাতির এলসি ৫১ শতাংশ এবং আমদানি ৬৪ শতাংশ কমেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে শিল্পের মৌলিক কাঁচামালের মধ্যে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল টেক্সটাইল ফ্যাব্রিকস আমদানির এলসি কমেছে ২০.২১ শতাংশ ও আমদানি কমেছে ২৮.০৯ শতাংশ। সার্বিকভাবে বস্ত্র খাতের সব উপকরণের আমদানি কমায় প্রভাব পড়েছে।

দেশে রাসায়িক পণ্যের অনেক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলো থেকে উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদার একটি অংশ মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করে। এই খাতের কাঁচামালের এলসি কমেছে ৪৮.২৩ শতাংশ। আমদানি কমেছে সাড়ে ৫২ শতাংশ।

নির্মাণ খাতের সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ক্লিংকার ও পাথর আমদানির এলসি কমেছে ৪৭.৮৬ শতাংশ। আমদানি কমেছে ৪১.৪৯ শতাংশ।

শিল্পের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে সরকারের বাস্তবিক কোনো সহায়তা নেই। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এখন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করছেন বলে জানান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল। তিনি এই সংকট মোকাবেলায় নিজেদের পদক্ষেপের বিষয়ে বলেন, আমরা দেশে-বিদেশে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। রপ্তানি বাড়ানোর দিকে বেশি জোর দিচ্ছি। আর আমরা বিভিন্ন জায়গায় উৎপাদনে দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করছি।

কামরুজ্জামান বলেন, কাঁচামাল আমদানিতে আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। খাদ্যপণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে যেতে পারছি। কিন্তু ইলেকট্রনিকস ও অন্যান্য পণ্যে বিনিয়োগ করে টিকে থাকা খুব চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে। তিনি বলেন, রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সহসা কোনো উপায় দেখছি না। আশা করছি নির্বাচনের পর পরিবেশ কিছুটা পরিবর্তন হবে।

নতুন বিনিয়োগে ভাটা, কমেছে ঋণপ্রবাহ

নতুন শিল্প স্থাপনেও মন্দা দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে এ খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে মাত্র সোয়া ১ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।

আবার ঋণ পরিশোধে ব্যয়ের চাপে আছেন ব্যবসায়ীরা। আগে থেকে নেওয়া ঋণের বিনিয়োগ থেকে আয় বাড়াতে পারছেন না তাঁরা। উল্টো এসব ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে এখন ১১.৪৭ শতাংশ হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ বাড়াতে পারছে না। এতে ব্যাংকগুলোতেও নগদ টাকার সংকট বাড়ছে। ফলে ব্যাংক খাতেও নাজুক পরিস্থিতি চলছে। নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করছে বেশির ভাগ ব্যাংক।