উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী কুবি শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন মেরী
বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪
১১ নভেম্বর ২০২৩, ১:২৬ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশের সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত, একটি পর্যটনস্থল। জাফলং, সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত। পর্যটনের সাথে জাফলং পাথরের জন্যও বিখ্যাত। বিচিত্রতার কষ্ঠিপাথরে বাংলাদেশকে যাচাই করতে হলে ঘুরে আসতে হবে দেশটির উত্তর-পূর্বের সিলেট বিভাগ। শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এর সমৃদ্ধ জেলাগুলো দেশের সেরা বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। শুধুমাত্র এক জাফলং ভ্রমণ যে কোনও জাতীয়তার পরিব্রাজকের মনে এক টুকরো বাংলাদেশকে গেঁথে দিতে যথেষ্ট। প্রকৃতি কন্যা হিসেবে খ্যাত এই পর্যটনস্থল ভ্রমণের নানা দিক নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের নিবন্ধ। চলুন, পাহাড়, নদী ও বনের এই অনিন্দ্য সমারোহকে খুব কাছ থেকে দেখার উপায়টি জেনে নেয়া যাক।
ঐতিহাসিকদের মতে বহু হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে থাকা এক নির্জন বনভূমি। জাফলং-এর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খাসি জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের ইতিহাস। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলেও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা পতিতও পড়েছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে খাসিদের মালনিয়াং রাজ্য থাকাকালে এর রাজধানীগুলোর একটি ছিলো বল্লাপুঞ্জি। এই বল্লাপুঞ্জি মূলত জাফলয়েরই একটি এলাকা। প্রাচীন এই মালনিয়াং রাজ্যেই উৎপত্তি হয়েছিলো জাফলং নামটির, যার মাধ্যমে আনন্দের হাট বোঝানো হতো। পরবর্তিতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন, আর পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে একসময় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি।
এই দর্শনীয় জায়গাটির অবস্থান সিলেট বিভাগীয় শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়টি মেঘালয় সীমান্তে আলাদা করেছে বাংলাদেশ ও ভারতকে। সীমান্তবর্তী জায়গাটি পড়েছে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার পিয়াইন নদীর অববাহিকায়।
বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় জাফলং অবস্থিত। এর অপর পাশে ভারতের ডাউকি অঞ্চল। ডাউকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাওকি নদী এই জাফলং দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মূলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। সিলেট জেলার জাফলং-তামাবিল-লালাখাল অঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ী উত্তলভঙ্গ। এই উত্তলভঙ্গে পাললিক শিলা প্রকটিত হয়ে আছে, তাই ওখানে বেশ কয়েকবার ভূতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। জাফলং-এ পাথর ছাড়াও পাওয়া গেছে সাদামাটি বা চীনামাটিও, যদিও সেখানে মাটি বা বালি পরিশোধন করার মতো কোনো অবকাঠামো নেই। এই এলাকায় যেমন সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করেন, তেমনি বাস করেন উপজাতিরাও। জাফলং-এর বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপুঞ্জী। আদমশুমারী অনুযায়ী জাফলং-এ ১,৯৫৩ জন খাসিয়া উপজাতি বাস করেন।
এটি এমন এক জায়গা যা প্রতি ঋতুতেই নতুন রূপে সেজে ওঠে। তবে বৃষ্টির মৌসুমে এই প্রকৃতি কন্যা নিজের সকল সৌন্দর্য্য যেন উজাড় করে দেয়। স্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর নিচে পাথরের ছোঁয়াছুয়ি খেলা, আর সংগ্রামপুঞ্জীর মায়া দৃষ্টি ভরে নিতে চাইলে আসতে হবে বর্ষাকালে। তাছাড়া জুন থেকে অক্টোবরের এই সময়টাতে; এমনকি নভেম্বরেও পাহাড়ের সবুজটা যেন আরও বেশি করে ফুটে ওঠে। জাফলং-এর বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়ালে ভারত সীমান্ত-অভ্যন্তরে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড়শ্রেণী দেখা যায়। এসব পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।
এছাড়া ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতুও আকর্ষণ করে অনেককে। সর্পিলাকারে বয়ে চলা ডাওকি নদীও টানে পর্যটকদের। মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের ফলে ভারত সীমান্তে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীর স্রোত বেড়ে গেলে নদী ফিরে পায় তার প্রাণ, আর হয়ে ওঠে আরো মনোরম। ডাওকি নদীর পানির স্বচ্ছতাও জাফলং-এর অন্যতম আকর্ষণ। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে জাফলং-এ আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলাকে ঘিরে উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। বর্ষাকাল আর শীতকালে জাফলং-এর আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বর্ষাকালে বৃষ্টিস্নাত গাছগাছালি আর খরস্রোতা নদী হয় দেখার মতো। তাছাড়া পাহাড়ের মাথায় মেঘের দৃশ্যও যথেষ্ট মনোরম।
পিয়াইন নদীর হাঁটু সমান পানিতে দাঁড়িয়ে মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের চূড়া খোঁজার অনুভূতির সঙ্গে কোনও কিছুর তুলনা চলে না। অদূরে জলপ্রপাত ঝুলন্ত সেতুর নিচ দিয়ে এসে দু’পা স্পর্শ করতেই সারা শরীরে বয়ে যাবে হিম-শীতল শিহরণ। কেননা বৃটিশ শাসনামলে গড়া এই সেতু সাক্ষী হয়ে আছে ১৮৯৭-এর ভূমিকম্পে সৃষ্টি হওয়ার ডাউকি ফল্টের।
এছাড়া পিয়াইনের শাখা ডাওকি নদীর সর্পিলাকার প্রবাহটাও অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে কাছে টানে পর্যটকদের। নৌকা করে ডাউকি নদীপথে কিছুক্ষণ ভেসে গেলেই দূরে হাতছানি দিয়ে ডাকবে সংগ্রামপুঞ্জি বা মায়াবী ঝর্ণা। আর পিয়াইন নদী পেরোলেই ওপারে খাসিয়াদের গ্রাম। পাহাড়ের কোলে তাদের অদ্ভূত বাড়ি নির্মাণশৈলী আর পানের বরজ হাজারও পর্যটকের বিস্ময়ের খোরাক যোগায়। অতঃপর সাক্ষাত মন্দিরজুম অবলীলায় গল্প বলতে শুরু করে খাসিদের ঐতিহাসিক মালনিয়াং রাজ্যের।
পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে সারা দেশের মতো জাফলংও আয়োজন করে বৈশাখী মেলার। উপলক্ষটা এক হলেও পাহাড় ঘেরা মুখরিত খরস্রোতা নদীর তীরকে অবশ্যই রাজধানীর জনস্রোতের মতো লাগবে না! সোনাটিলা গ্রামে প্রতিদিন বৃষ্টি হওয়ার কিংবদন্তি চাক্ষুষ করতে এখনও কৌতূহলী চোখে ঘুরে বেড়ান ভ্রমণপিপাসুরা।
ঢাকার গাবতলী, মহাখালী, ফকিরাপুল, অথবা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের যে কোনটি থেকে বাসে করে সিলেট যাওয়া যাবে। এগুলোতে এসি, নন-এসি এবং কোম্পানি ভেদে জনপ্রতি ভাড়া পড়ে ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা। পুরো যাত্রায় সময় লাগবে প্রায় ৬ থেকে ৮ ঘন্টা।
এছাড়া ট্রেন ভ্রমণ করতে চাইলে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে উঠে পড়া যায়। শ্রেণী ভেদে এগুলোর টিকেট মূল্য নিতে পারে মাথাপিছু সর্বনিম্নে ৩২০ থেকে সর্বোচ্চ ১০৯৯ টাকা। এই যাত্রাতেও কমবেশি ৭ থেকে ৮ ঘন্টা সময় লেগে যায়।
সবচেয়ে দ্রুত সময়ে সিলেট পৌঁছানোর একমাত্র উপায় বিমানে যাওয়া। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এই যাত্রায় বিভিন্ন শ্রেণী অনুযায়ী খরচ পড়তে পারে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। মাত্র ৩০ থেকে ৪৫ মিনিটে এই যাত্রা শেষ হয় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
চট্টগ্রাম থেকে গ্রীনলাইন, এনা, সৌদিয়া ও লন্ডন এক্সপ্রেস সহ অন্যান্য পরিবহনে বেশকিছু বাস সিলেট যায়। এসি বাস ভাড়া ১২০০-১৪০০ টাকা ও নন-এসি বাসের ভাড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার পাহাড়িকা এবং উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করে। শ্রেণী অনুযায়ী ট্রেনের টিকেটের মূল্য ৩৭৫ থেকে ১৩৩৮ টাকা। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে বিমানে ঢাকা হয়ে সিলেট যাবার সুযোগ রয়েছে।
সিলেটের কদমতলী এবং সোবহানীঘাট থেকে জাফলং-এর বাসগুলো ছাড়ে। এগুলোতে ভাড়া নেয় জনপ্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। বাস বাদে জাফলং-এ যাওয়ার সিএনজি ও লেগুনা সার্ভিস রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে মাইক্রোবাসও ভীড় করে থাকে বন্দরবাজারের শিশুপার্কের সামনে।
এছাড়াও সিলেটের প্রায় সব জায়গাতেই রিজার্ভ করার জন্য গাড়ি পাওয়া যায়। তবে যে যানবাহনেই যাওয়া হোক না কেন, সরাসরি জাফলং পৌঁছতে প্রায় দেড় থেকে ২ ঘন্টা সময় লেগে যাবে। যাওয়া-আসাসহ সারাদিনের জন্যে সিএনজি ভাড়া নিতে পারে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। খরচটা লেগুনার ক্ষেত্রে হয়ে যাবে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। মাইক্রোবাস রিজার্ভ করার জন্য ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা লাগতে পারে।
এই গাড়িগুলো বিভিন্ন পথে জাফলং-এর জিরো পয়েন্টে নিয়ে যায়। তবে রিজার্ভ গাড়িতে পছন্দমত রাস্তা ব্যবহার করার সুবিধা থাকে। বিশেষ করে গুচ্ছগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প দিয়ে যাওয়ার রাস্তাটি উত্তম। অবশ্য এখন জাফলং যাবার রাস্তাগুলো আগের থেকে বেশ উন্নত হয়েছে।
জাফলং-এ থাকার জন্য মামার বাজারে অল্প কিছু রেস্ট হাউজ আছে। সরকারি রেস্ট হাউজটিতে থাকার জন্য অনুমতি নিয়ে নিতে হবে।
আরও ভালো হোটেলে থাকতে হলে ফিরে যেতে হবে সিলেট শহরে। শহরের অধিকাংশ হোটেলগুলো শাহজালাল মাজারের আশেপাশেই। দরগা গেট থেকে আম্বরখানা, লামাবাজার, জিন্দাবাজার, তালতলা, কদমতলী পর্যন্ত বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যাবে। তন্মধ্যে দরগা গেট এলাকায় রুম ভাড়া পাওয়া যাবে ১ থেকে ২ হাজার টাকায়। অভিজাত হোটেলগুলোতে ২ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেগে যায়। রিসোর্টগুলোর কোনও কোনওটিতে ৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ লাগতে পারে।
জাফলংয়ে মোটামুটি মানের কিছু রেস্টুরেন্ট আছে যেগুলোতে যে কোনও বেলা ভরপেট খাওয়া সম্ভব। সিলেট শহরে সাশ্রয়ী মূল্যে খেতে হলে যেতে হবে জিন্দাবাজারের রেস্টুরেন্টগুলোতে। এগুলোর বিশেষত্ব বিভিন্ন ধরনের ভর্তা, খিচুড়ি এবং মাংসের অভিনব পরিবেশন। এগুলোতে সকালের নাস্তায় খরচ পড়তে পারে জনপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকায়। আর দুপুর বা রাতের খাবারের জন্য জনপ্রতি ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
জাফলং-এর সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা। পিয়াইন নদী পেরিয়ে ১৫ কিলোমিটার হেঁটে গেলেই দেখা মেলে এই অপার সৌন্দর্য্যের। তবে প্রাকৃতিক এই প্রস্রবনে ভেজার সাধ জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে দেখতে হবে। কেননা দুর্ভাগ্যজনকভাবে জলপ্রপাতটি পড়েছে ভারতের অংশে।
এছাড়া বিছানাকান্দিতে পাওয়া যাবে পান্থুমাই ঝর্ণা। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে সংগ্রামপুঞ্জির চা বাগান, লালাখাল, তামাবিল জিরো পয়েন্ট, কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, এবং রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, এবং ডিবির হাওর- শাপলা বিল।
স্বচ্ছ পানির নদী, চিত্তাকর্ষক ঝুলন্ত ব্রীজ এবং পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে উপজাতিদের বসতি; এর সবেই মিলছে সিলেটের জাফলং ভ্রমণ-এ। এক নিমেষে এত কিছুর সাক্ষাত দেশের অন্য কোথাও পেতে প্রয়োজন হবে আরও কিছু সময়ের। সেদিক থেকে নিঃসন্দেহে প্রকৃতি কন্যার আতিথেয়তার কোন তুলনা হয় না। এরপরেও সে পরম বিনয় ভরে পর্যটকদের নির্দেশ করে সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণার দিকে। আর এই অপরুপ লাবণ্যতার জন্যই আবারও ফিরে যেতে মন চাইবে এই পিয়াইন নদীর বুকে।